নবীজীর (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর সাহাবীদের জীবনী পর্ব -২

নবীজীর  (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)  এর সাহাবীদের জীবনী পর্ব -২ - biography-of-companions-of-prophet-part-2


নবীজীর  (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)  এর সাহাবীদের জীবনী পর্ব -২ 

হযরত উমার ইবনুল খাত্তাব (রাঃ) জীবনী ও ঘটনা


রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর বিশিষ্ট সাহাবী, ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা, খুলাফাই রাশিদুন এর অন্যতম, ইসলামী রাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান রূপকার ।

ইসলাম ধর্ম গ্রহন

হযরত মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর নবুওয়াতের প্রথম পর্যায়ে উমার (রাঃ) ছিলেন ঘোর ইসলাম বিরোধী । মক্কার নবদীক্ষিত মুসলিমদের উপর তিনি নির্যাতন চালাইতেন । তিনি ইসলামী আন্দোলনের বিরোধিতা করিতেছিলেন বটে, কিন্তু পরোক্ষে ইসলামের প্রভাবে তাহার শুভবুদ্ধি ক্রমশ জাগরিত হইতেছিল । রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর অজ্ঞাতসারে একদা তাহার মুখে কুরানের আবৃত্তি শুনিয়া তাহার মনে ভাবান্তর ঘটার বর্ননা পাওয়া যায় । একদিন ভগিনী ও ভগ্নীপতিকে ইসলামে গ্রহণের জন্য নির্দয়ভাবে শাসন করিতে গিয়া নিজেই তিনি ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হইয়া পড়েন এবং রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর নিকট উপস্থিত হইয়া ইসলাম গ্রহণ করেন । ইসলাম গ্রহণের ফলে তাহার জীবনের আমূল পরিবর্তন হয় । পরবর্তীকালে তিনি ইসলামের সেবার অক্ষয় কীর্তি রাখিয়া যান ।

খিলাফত লাভের পূর্বে খেদমত

হিজরতের চারি বৎসর পূর্বে যখন তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন তখন তাহার বয়স ছিল ছাব্বিশ বৎসর । তাহার পর হইতে তিনি পূর্ন শক্তিতে ইসলামের খিদমতে ঝাপাইয়া পড়েন । তাহার গোত্র বানু আদি ইবন্‌ কা~ব হইতে এই ব্যাপারে তিনি কোন সাহায্য পান নাই । মদিনায় তাহার ব্যক্তিগত উদ্যম এবং মনোবলের প্রভাবেই তিনি রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর প্রতিষ্ঠিত ইসলামী সমাজে মর্যাদা লাভ করেন, গোত্রীয় মর্যাদারকারণে নয় । সৈনিক হিসাবেও তাহার প্রভূত খ্যাতি ছিল । তিনি বদর, উহুদ ও অন্যান্য যুদ্ধে যোগদান করেন । হাদিছে আছে যে, কুরআনের কয়েকটি স্থানে উমার (রাঃ) এর উক্তি সমর্থনে অয়ায়হি অবতীর্ন হইয়াছিল । যথাঃ ২ঃ১২৫- কাবা গৃহের পার্শস্থ মাকাম ইব্রাহীমে সালাত আদায়; ৩৩ঃ৫৩, রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বিবিগণের সামনে পর্দা পালন ইত্যাদি । 

সাহাবীগণের মধ্যে শ্রেষ্ঠত্বে হজরত আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ) হযরত উমার (রাঃ) এর অগ্রগণ্য ছিলেন । হযরত উমার (রাঃ) বিনয় সহকারে তাহা স্বীকার করিতেন এবং সর্বদা হযরত আবু বকর (রাঃ) কে যথোপযুক্ত সম্মান দেখাইতেন । তাহাদের কন্যাগণ রাসূল (সাঃ) এর পবিত্র বিবি তথা উম্মতের জননী হইবার সৌভাগ্য অর্জন করিয়াছিলেন । রাসূল কারীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর বিবি হযতর হাফসা (রঃ) হযতর উমার (রাঃ) এর কন্যা ছিলেন । রাসূল কারীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামসাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামসাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর ওফাতের পর হযরত উমার (রাঃ) ই সর্বপ্রথম হযরত আবু বকর (রাঃ) এর নিকট বায়াত হন ।


খেলাফত লাভ ও শাসনকার্য

হযরত আবু বকর (রাঃ) এর খিলাফাতকালে হযরত উমার (রাঃ) ই ছিলেন তাহার প্রধান উপদেষ্টা । মৃত্যুর পূর্বে তিনি উমার (রাঃ) কেই তাঁহার স্থলাভিষিক্ত মনোনীত করেন, সাহাবীগণও সর্ব-সম্মতভাবে উমার (রাঃ) কে তাহাদের খলীফারুপে গ্রহণ করেন এবং এইরূপে নেতা নির্বাচনের আরবীয় প্রথানুসারে জনগণের সমর্থনের ভিত্তিতেই উমার (রাঃ) তাঁহার খিলাফাত শুরু করেন । ঘরে বাহিরে উমার (রাঃ) যে পরিস্থিতির সম্মুখীন হইলেন পূর্ব হইতেই তিনি ইহার সহিত ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত ছিলেন । মুসলিম রাষ্ট্রের পরিধি বৃদ্ধি করিবার জন্য যুদ্ধ করা তাঁহার অভিপ্রেত ছিল না । নৌ-যুদ্ধ তাঁহার দৃষ্টিতে অধিকতর অবাঞ্ছিত, কিন্তু মুসলিম শক্তিকে অঙ্কুরে বিনষ্ট করিবার জন্য বদ্ধপরিকর বিরুদ্ধ শক্তিগুলির সহিত মুকাবিলায় তিনিই ছিলেন অধিনায়ক । যে সকল সেনাপতি মুসলিমদের প্রয়াসকে সাফল্যমণ্ডিত করিয়াছিলেন তিনি ছিলেন তাহাদের সকলের নিয়ন্তা । এইক্ষেত্রে তাঁহার কৃতিত্ব সর্বজনবিদিত । 

ইসলামের স্বার্থে খালিদ (রাঃ) এর ন্যায় একজন সুদক্ষ সেনাপতিকেও তিনি পদচ্যুত করিয়াছিলেন এবং খালিদ (রাঃ) ও এই পদচ্যুতি অবনত মস্তকে মানিয়া লইয়াছিলেন । ইহা তাঁহার বলিষ্ঠ কৃতিত্বেরই পরিচায়ক । এই ঘটনা হইতে রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর সাহাবী (রাঃ) গনের চরিত্র বৈশিষ্ট্যেরও পরিচয় মিলে । ‘আম্‌র ইবনুল আস (রাঃ) এর মিসর বিজয়ের প্রস্তাবে সম্মতি দান করিয়া তিনি খুবই দূর-দৃষ্টির পরিচয় দেন । তিনি রাসূল কারীম (সাঃ) এর বিশিষ্ট সাহাবীদিগকে সম্ভ্রমবশত সাধারণ সরকারী চাকুরীতে নিয়োগ করিতেন না । কিন্তু প্রয়োজন হইলে গুরুত্বপূর্ন পদে তাহাদিগকে নিয়োগ করিতে দ্বিধাবোধ করিতেন না । এইরূপে ইরাক ও সিরিয়ার শাসনকর্তা হিসাবে তিনি কয়েকজনকে নিযুক্ত করেন ।


হযরত উমার (রাঃ) এর সময়েই ইসলামী রাষ্ট্রের বাস্তব ভিত্তি স্থাপিত হয় । এই সময়েই অনেকগুলি ইসলামী বিধি-ব্যবস্থা বাস্তব রূপ লাভ করে বলিয়া কথিত হয় । এইগুলির পূর্ন রুপায়ন ঐতিহাসিক বিকাশ ধারা অনুসারে ক্রমে ক্রমে সাধিত হইলেও ইহাদের সূচনা হযরত উমার (রঃ) এর সময়েই হইয়াছিল । যখনই কোন প্রশ্ন বা সমস্যার উদ্ভব হইত, তিনি সাহাবী (রাঃ) গনকে একত্র করিয়া জিজ্ঞাসা করিতেন সেই ব্যাপারে হযরত (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর কোন উক্তি বা সিদ্ধান্ত আছে কিনা তাহাদের সহিত আলোচনার ভিত্তিতে তিনি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিতেন । কুরআন ও সুন্নাহ্‌ই ছিল তাঁহার সংবিধান এবং বিশিষ্ট সাহাবী [যথা আলী, আব্দুর রাহমান ইবন আওফ (রাঃ) প্রমুখ] গণ ছিলেন তাঁহার পরামর্শ সভার সদস্য । দীনতম নাগরিকও তাঁহার কর্মের সমালোচনা করিতে শুধু সাহসীই নহে বরং উৎসাহিতও হইতেন- ইহার বহু নজির পাওয়া যায় । তাঁহার জীবন যাপনের মান সাধারণ নাগরিকের অনুরূপ ছিল । এই বিষয়ে হযরত উমার (রাঃ) এর দৃষ্টান্ত সত্যই বিরল ।


জিম্মি (মুসলিম রাষ্ট্রের অমুসলিম নাগরিক) গণের অধিকার সংরক্ষণ, সরকারি আয় জনগণের মধ্যে বণ্টনের জন্য দীওয়ান ব্যবস্থার প্রবর্তন, সামরিক কেন্দ্র (যথাঃ বসরা, কুফা)- সমূহ প্রতিষ্ঠা (এই সকল কেন্দ্র হইতেই উত্তরকালে কয়েকটি বৃহৎ নগরীর সৃষ্টি হয়) । এতদ্বব্যতিত ধর্মীয়, পৌর এবং দণ্ডবিধি সঙ্ক্রান্ত বিশেষ বিধিও তিনি প্রবর্তন করেন । যথাঃ তারাবীহের সালাত জামা~আতে সম্পন্ন করা, হিজরি সনের প্রবর্তন, মদ্যপানের শাস্তি ইত্যাদি ।


আবু বকর (রাঃ) খলীফা (খালীফাতু রাসুলুল্লাহ বা রাসুলের প্রতিনিধি) বলিয়া অভিহিত হইতেন । তদনুসারে উমার (রাঃ) ছিলেন রাসূলের খলীফার খলীফা । হযরত (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) নেতা অর্থে সাধারনত আমীর শব্দের ব্যবহার করিতেন এবং আরবদের মধ্যে এই শব্দের ব্যবহার প্রচলিত ছিল । ১৯ হিজরিতে তিনি এই উপাধি গ্রহণ করেন । সম্ভবত তিনি নিজকে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর খলীফা বা স্থলাভিষিক্ত বলা বা মনে করাকে ধৃষ্টতারুপ গণ্য করিতেন । হাদিছে বিবৃত হইয়াছে যে, রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলিয়াছেন, ~আমার পর কেহ নবী হইলে উমার নবী হইত । (দ্রঃ আল মুহিব্বুত-তাবারী, মানাকিবুল আশারাঃ ১খ, ১৯৯)


হযরত উমার রাদিয়াল্লাহু আনহুর শাহাদাত


উমার (রাঃ) এর অন্তরে আল্লাহ্‌র ভয় ও ভক্তির মধ্যে দৃশ্যত ভয়ই ছিল প্রবলতর । তিনি যে সম্মান অর্জন করেন তাহা তাঁহার চরিত্রগুণের কারনে, শারীরিক শক্তির জন্য নহে । যদি আবু উবায়দা (রাঃ) জীবিত থাকিতেন তবে তাহাকেই তাঁহার স্থলাভিষিক্তরুপে মনোনীত করিতেন, তাঁহার এইরূপ ইচ্ছা প্রকাশের বিবরন পাওয়া যায় । হযরত মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর সত্যিকারের সাহাবী এবং কুরআন ও সুন্নাহ্‌র পুঙ্খানুপুঙ্খ অনুসারী খলীফারুপে মর্যাদার উচ্চ শিখরে সমাসীন থাকাকালে ২৬ জুল হিজ্জাঃ ২৩/৩ নভেম্বর, ৬৪৪ সালে তিনি মুগীরাঃ ইবন শু~বা~র খ্রিষ্টান ক্রীতদাস আবু লু~লু~র ছুরিকাঘাতে শাহাদাত প্রাপ্ত হন । ইতিহাসে কথিত হইয়াছে যে, উমার (রাঃ) এর নিকট আবু লু~লু~ তাঁহার মনিবের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে । উমার (রাঃ) এর বিচারে অসন্তুষ্ট হইয়া সে নিহায়েত ব্যক্তিগত আক্রোশের বশে অতর্কিতভাবে তাহাকে হত্যা করে । মৃত্যুর পূর্বে উমার (রাঃ) ছয়জন বিশিষ্ট সাহাবীর নামোল্লেখ (‘উছমান এবং আলী (রাঃ) ও তাহাদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিলেন ) করিয়া পরামর্শক্রমে তাহাদের মধ্যে একজনকে খলীফা মনোনীত করার উপদেশ দিয়া যান । ইহার ফলে হযরত উছমান (রাঃ) খলীফা মনোনীত হন।


আল মুহিব্বুল তাবারীর আর-রিয়াদুন-নাদিরা ফী মানাকিবিল আশারাঃ, কায়রো ১৩২৭, পুস্তকে তাঁহার গুণাবলীর আলোচনা আছে । শীআ সম্প্রদায় তাহাকে ভাল চক্ষে দেখে নাই; কারন তাঁহারা মনে করে, যাহাদের কারণে আলী (রাঃ) রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর খিলাফাতে অধিষ্ঠিত হইতে পারেন নাই, উমার (রাঃ) তাহাদের অন্যতম । সূফীগণ হযরত উমার (রাঃ) এর অনাড়ম্বর জীবন যাপন পদ্ধতির প্রশংসা করিয়াছেন ।


ওমর (রা.)-কে ৪টি ঐতিহাসিক প্রশ্ন করেছিলেন এক খিৃস্টান বাদশাহ


ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমর (রা.) কে এক খৃষ্টান বাদশাহ চারটি প্রশ্ন লিখে চিঠি পাঠিয়েছিলেন এবং আসমানী কিতাবের আলোকে প্রশ্নের উত্তর চেয়েছিলেন। সেই চিঠির ৪টি প্রশ্ন পরবর্তিতে ঐতিহাসিক প্রশ্ন হিসেবে সবার কাছে সমাদৃত হয়ে আছে।


১ম প্রশ্নঃ একই মায়ের পেট হতে দু’টি বাচ্চা একই দিনে একই সময় জন্ম গ্রহন করেছে এবং একই দিনে ইন্তেকাল করেছে তবে, তাদের একজন অপরজন থেকে ১০০ বছরের বড় ছিলো। তারা দুইজন কে? কিভাবে তা হয়েছে?

২য় প্রশ্নঃ পৃথিবীর কোন্ স্থানে সূর্যের আলো শুধুমাত্র একবার পড়েছে। কেয়ামত পর্যন্ত আর কখনো সূর্যের আলো সেখানে পড়বে না?

৩য় প্রশ্নঃ সে কয়েদী কে, যার কয়েদ খানায় শ্বাস নেওয়ার অনুমতি নেই আর সে শ্বাস নেওয়া ছাড়াই জীবিত থাকে?

৪র্থ প্রশ্নঃ সেটি কোন কবর, যার বাসিন্দা জীবিত ছিল এবং কবরও জীবিত ছিল, আর সে কবর তার বাসিন্দাকে নিয়ে ঘোরাফেরা করেছে এবং কবর থেকে তার বাসিন্দাজীবিত বের হয়ে দীর্ঘকাল পৃথিবীতে জীবিত ছিল?


হযরত ওমর (রাঃ) হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) কে ডাকলেন এবং উত্তরগুলো লিখে দিতে বললেন।


১ম উত্তরঃ দুই ভাই ছিলেন হযরত ওযায়ের (আঃ) এবং ওযায়েয (আঃ) তারা একই দিনে জন্ম এবং একই দিনে ইন্তেকাল করা সত্বেও ওযায়েয (আঃ) ওযায়ের (আঃ) থেকে ১০০ বছরের বড় হওয়ার কারন হল, মানুষকে আল্লাহ তায়ালা মৃত্যুর পর আবার কিভাবে জীবিত করবেন? হযরত ওযায়ের (আঃ) তা দেখতে চেয়ে ছিলেন। ফলে, আল্লাহ তাকে ১০০ বছর যাবত মৃত্যু অবস্থায় রাখেন এরপর তাঁকে জীবিত করেন। যার কারনে দুই ভাইয়ের বয়সের মাঝে ১০০ বছর ব্যবধান হয়ে যায়।


২য় উত্তরঃ হযর মুসা (আঃ) এর মু’জিযার কারনে বাহরে কুলযুম তথা লোহিত সাগরের উপর রাস্তা হয়ে যায় আর সেখানে সূর্যের আলো পৃথিবীর ইতিহাসে একবার পড়েছে এবং কেয়ামত পর্যন্ত আর পড়বে না।


৩য় উত্তরঃ যে কয়েদী শ্বাস নেওয়া ছাড়া জীবিত থাকে, সে কয়েদী হল মায়ের পেটের বাচ্চা, যে নিজ মায়ের পেটে কয়েদ (বন্দী) থাকে।


৪র্থ উত্তরঃ যে কবরের বাসিন্দা জীবিত এবং কবরও জীবিত ছিলো, সে কবরের বাসিন্দা হলেন, হযরত ইউনুস (আঃ) আর কবর হল, ইউনুস (আঃ) যে মাছের পেটে ছিলেন- সে মাছ। আর মাছটি, ইউনুস (আঃ) কে নিয়ে ঘোরাফেরা করেছে। মাছের পেট থেকে বের হয়ে আসার পর, ইউনুস (আঃ) অনেক দিন জীবিত ছিলেন। এরপর ইন্তেকাল করেন।


দুই বিখ্যাত সাহাবী আবু বকর (রা) ও উমার (রা) কথা বলছিলেন


দুই বিখ্যাত সাহাবী আবু বকর (রা) ও উমার (রা) কথা বলছিলেন। হঠাৎ আবু বকরের কথায় উমার মারাত্মক রেগে গেলেন। এমনকি ওই স্থান ছেড়ে চলে গেলেন। আবু বকর (রা) খুবই লজ্জিত ও উদ্বিগ্ন হয়ে উমারের পেছনে পেছনে ছুটতে লাগলেন আর বলতে লাগলেন, ‘ভাই উমার, আমার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করুন।’ উমার (রা) ফিরেও তাকাচ্ছেন না! এক পর্যায়ে তিনি বাড়ি চলে গেলেন, পেছনে পেছনে আবু বকরও তার ঘরের দরজায় পা রাখলেন। কিন্তু উমার (রা) আবু বকর (রা) এর মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দেন।


উদ্বিগ্ন আবু বকর ছুটে গেলেন মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর কাছে। একটু পর উমারও সেখানে হাজির। আসলে দুজনই অনুতপ্ত, লজ্জিত। উমার (রা) নিজের দোষ স্বীকার করে সব বর্ণনা দিলেন, কীভাবে আবু বকরের মুখের উপর দরজা লাগিয়ে দিয়েছেন তিনি। সব শুনে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) উমারের উপর খুবই অসন্তুষ্ট হলেন। আবু বকর (রা) আর সহ্য করতে পারলেন না। তিনি বলতে লাগলেন, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ! ভুল আমারই হয়েছে, তার কোন ভুল নেই।’ তিনি উমার (রা) কে নির্দোষ প্রমাণ করতে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাচ্ছিলেন।…(সহীহ বুখারী, হাদীস নং- ৪২৭৪)


সুবহানাল্লাহ। কী চরিত্র, কী বিনয়, কী আচরণ! সোনার মানুষ ছিলেন তাঁরা, সত্যিই সোনার মানুষ। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মানুষটির শিষ্যগণ তো এমনই হবেন। আমরা কত বড় দুর্ভাগা যে, তাঁদের জীবনীটা কখনো পড়ে দেখিনি, তাঁদেরকে উত্তম আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করার চিন্তাও করিনি। তাঁদেরকে জানুন। টপ টপ করে চোখ দিয়ে পানি পড়বে তাঁদের জীবনী পড়লে।


তাঁদের অন্তরগুলো ছিল স্ফটিকের মত স্বচ্ছ। তাঁরা শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই একে অপরকে ভালবাসতেন। এই পয়েন্টটিতে কেন আমরা এত পিছিয়ে? একই পথের পথিক হয়েও কেন আমাদের মধ্যে এত হিংসা, বিদ্বেষ, শত্রুতা? নিশ্চিত থাকুন, আখিরাতে এর চরম মূল্য দিতে হবে।


বিচারকের মসনদে হযরত ঊমার (রাঃ)


হযরত উমর রা.-এর দরবার। দাড়ি-মোচ হীন এক যুবকের লাশ উপস্থিত করা হলো দরবারে। নিহত যুবকের লাশ রাস্তা থেকে কুড়িয়ে এনেছে পুলিশের লোকেরা। হত্যা করা হয়েছে তাকে। আমীরুল মুমিনীন পেরেশান। বহু তত্ত্ব-তালাশ ও অনুসন্ধানের পরও হত্যার কোনো ক্লু খুঁজে পেলেন না। বিষয়টি নিয়ে অনেক চিন্তিত তিনি। কোনো উপায়ন্তর না দেখে দ্বারস্ত হলেন দরবারে এলাহিতে। দোয়া করলেন, হে প্রভু! এই যুবকের হত্যা রহস্যকে তুমি আমার সামনে উদ্ঘাটন করে দাও।


এক বছর পর। যে স্থানে যুবকের লাশ পাওয়া গিয়েছিলো, ঠিক সেখানেই পাওয়া গেলো একটি সদ্য ভুমিষ্ট নবজাতক। শিশুটিকে উপস্থিত করা হলো দরবারে। তৃপ্তির হাসি ফুটে উঠলো হযরত উমরের চোখে মুখে। বললেন, ইনশাআল্লাহ এবার সে যুবকের হত্যা রহস্য উদ্ঘাটিত হবে। শিশুটিকে তিনি একজন মহিলার হাতে অর্পণ করে বললেন, তুমি তাকে যত্নের সাথে লালন করবে এবং তার যাবতীয় খরচাদি আমার কাছ থেকে মাস শেষে নিয়ে যাবে। অতঃপর বললেন, শিশুটিকে লালন-পালন করার মধ্যবর্তী সময়ে লক্ষ্য রাখবে কোনো মহিলা শিশুটিকে নিতে আসে কি না। অথবা কেউ তাকে আদর সোহাগ করে চুমো দেয় কি না। যদি এমন কিছু ঘটে তাহলে সাথে সাথে আমাকে খবর দিবে এবং তার ঠিকানা সম্পর্কে আমাকে অবহিত করবে।


কেটে গেলো কয়েক বছর। শৈশব পেরিয়ে কৈশোরে পদার্পণ করেছে ছেলেটি। একদিন একজন দাসী এসে মহিলাকে বললো, আমার মুনিবা আমাকে আপনার নিকট পাঠিয়েছেন ছেলেটিকে আমার সাথে পাঠানোর জন্য। তিনি তাকে একটু দেখতে চান। মহিলা বললো, ঠিক আছে চলো, আমিও যাবো সাথে। ছেলেটিকে নিয়ে যখন তারা সে বাড়িতে পৌঁছল তখন কৃতদাসীর মুনিবা তাকে কোলে তুলে নিলো, বুকে জড়িয়ে আদর-সোহাগ করতে লাগলো। চুমোয় চুমোয় ভরিয়ে দিলো তাকে।


খবর নিয়ে জানা গেলো উক্ত মুনিবা একজন আনসারী সাহাবীর মেয়ে। এবার সেই মহিলা কালবিলম্ব না করে হযরত উমরের দরবারে উপস্থিত হয়ে ঘটনার সবিস্তার বর্ণনা দিলো। হযরত উমর রা. ঘটনা শুনামাত্র তলোয়ার হাতে রওয়ানা হলেন আনসারী মহিলার বাড়িতে। পৌঁছলেন। মহিলার পিতা তখন দরজায় হেলান দিয়ে বসা ছিলেন।


হযরত উমর রা.-এর দরবার। দাড়ি-মোচ হীন এক যুবকের লাশ উপস্থিত করা হলো দরবারে। নিহত যুবকের লাশ রাস্তা থেকে কুড়িয়ে এনেছে পুলিশের লোকেরা। হত্যা করা হয়েছে তাকে। আমীরুল মুমিনীন পেরেশান। বহু তত্ত্ব-তালাশ ও অনুসন্ধানের পরও হত্যার কোনো ক্লু খুঁজে পেলেন না। বিষয়টি নিয়ে অনেক চিন্তিত তিনি। কোনো উপায়ন্তর না দেখে দ্বারস্ত হলেন দরবারে এলাহিতে। দোয়া করলেন, হে প্রভু! এই যুবকের হত্যা রহস্যকে তুমি আমার সামনে উদ্ঘাটন করে দাও।


এক বছর পর। যে স্থানে যুবকের লাশ পাওয়া গিয়েছিলো, ঠিক সেখানেই পাওয়া গেলো একটি সদ্য ভুমিষ্ট নবজাতক। শিশুটিকে উপস্থিত করা হলো দরবারে। তৃপ্তির হাসি ফুটে উঠলো হযরত উমরের চোখে মুখে। বললেন, ইনশাআল্লাহ এবার সে যুবকের হত্যা রহস্য উদ্ঘাটিত হবে। শিশুটিকে তিনি একজন মহিলার হাতে অর্পণ করে বললেন, তুমি তাকে যত্নের সাথে লালন করবে এবং তার যাবতীয় খরচাদি আমার কাছ থেকে মাস শেষে নিয়ে যাবে। অতঃপর বললেন, শিশুটিকে লালন-পালন করার মধ্যবর্তী সময়ে লক্ষ্য রাখবে কোনো মহিলা শিশুটিকে নিতে আসে কি না। অথবা কেউ তাকে আদর সোহাগ করে চুমো দেয় কি না। যদি এমন কিছু ঘটে তাহলে সাথে সাথে আমাকে খবর দিবে এবং তার ঠিকানা সম্পর্কে আমাকে অবহিত করবে।


কেটে গেলো কয়েক বছর। শৈশব পেরিয়ে কৈশোরে পদার্পণ করেছে ছেলেটি। একদিন একজন দাসী এসে মহিলাকে বললো, আমার মুনিবা আমাকে আপনার নিকট পাঠিয়েছেন ছেলেটিকে আমার সাথে পাঠানোর জন্য। তিনি তাকে একটু দেখতে চান। মহিলা বললো, ঠিক আছে চলো, আমিও যাবো সাথে। ছেলেটিকে নিয়ে যখন তারা সে বাড়িতে পৌঁছল তখন কৃতদাসীর মুনিবা তাকে কোলে তুলে নিলো, বুকে জড়িয়ে আদর-সোহাগ করতে লাগলো। চুমোয় চুমোয় ভরিয়ে দিলো তাকে।


খবর নিয়ে জানা গেলো উক্ত মুনিবা একজন আনসারী সাহাবীর মেয়ে। এবার সেই মহিলা কালবিলম্ব না করে হযরত উমরের দরবারে উপস্থিত হয়ে ঘটনার সবিস্তার বর্ণনা দিলো। হযরত উমর রা. ঘটনা শুনামাত্র তলোয়ার হাতে রওয়ানা হলেন আনসারী মহিলার বাড়িতে। পৌঁছলেন। মহিলার পিতা তখন দরজায় হেলান দিয়ে বসা ছিলেন। হযরত উমর রা. তাকে বললেন, হে অমুক! তোমার অমুক মেয়ের হালাত কী ? মহিলার পিতা বললো, হে আমীরুল মুমিনীন ! আস’আদাকাল্লাহ ! আমার মেয়ে আল্লাহর হক, মানুষের হক, পিতামাতা ও আত্মীয়-স্বজনের হক, মানুষের সাথে আচার-আচরণ, চাল-চলন, নামায়-রোযা দ্বীনদারী ইত্যাদি সর্ববিষয়ে বেশ যত্নশীল।


হযরত উমর বললেন, আমি তোমার মেয়ের সাথে সাক্ষাত করতে চাই। আমি তাকে নেক কাজে আরো উৎসাহিত করবো। অতঃপর মহিলার পিতাসহ হযরত উমর মহিলার ঘরে প্রবেশ করলেন। গৃহে প্রবেশের পর হযরতউমর মহিলার পিতাকে বললেন, তুমি ঘর থেকে বেরিয়ে যাও। মহিলার পিতা ঘর থেকে বেরিয়ে গেলে উমর রা. তরবারী কোষমুক্ত করে বললেন, যা ঘটেছে সব সত্য সত্য বলো, না হয় তোমার গর্দান উড়িয়ে দিবো।


মহিলা বললো, হে আমীরুল মুমিনীন! আপনি শান্ত হোন। অবশ্যই আমি সত্য খুলে বলবো। এই বলে সে বলতে শুরু করলো, জনাব! আমাদের গৃহে এক বৃদ্ধা মহিলা আসা যাওয়া করতো। এক পর্যায়ে তার সাথে আমার এমন ঘনিষ্টতা হয় যে, আমি তাকে স্বীয় মায়ের মতো শ্রদ্ধা করতাম। কারণ, তিনিও আমাকে মায়ের মতো আদর-যত্ন করতো। মহব্বত করতো। এভাবে দীর্ঘদিন কেটে যায়। একদিন সে আমাকে বললো, বেটী! আমি সফরে যাওয়ার ইচ্ছে করেছি। ঘরে আমার এক মেয়ে আছে। তার ব্যাপারে খুব শংকিত। তাকে কোথায় রেখে যাবো। শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত করেছি তাকে তোমার নিকট রেখে যাবো। আমি সফর থেকে ফেরা পর্যন্ত সে তোমার কাছে অবস্থান করবে। একথা বলে তিনি তার ছেলেকে মেয়ের সাজে সজ্জিত করে আমার নিকট রেখে গেলেন।


তার চাল-চলন বেশ-ভূষা সবকিছু মেয়েদের মতো। সে মেয়ে হওয়ার ব্যাপারে আমার মনে সামান্যতম সন্দেহের উদয় হয়নি। সুতরাং দুইজন মেয়ে এক সাথে সাধারণতঃ যেভাবে চলা-ফেরা, উঠা-বসা করে, আমিও তার সাথে সেভাবে কাটাতে লাগলাম। এভাবে বেশ ক‘দিন অতিবাহিত হলো।


একদিন আমি ঘুমিয়ে আছি। সুযোগ বুঝে সে আমার উপর চড়ে বসে এবং আমি কিছু অনুমান করার আগেই সে আমার সতীত্ব হরণ করে নেয়। অবস্থা বুঝে উঠার পর আমার হাতের কাছে ছিলো একটা ছুরি, সেটা দিয়ে তাকে খুন করি। এরপর খাদেমাকে নির্দেশ দেই তাকে সেখানে ফেলে আসতে যেখানে আপনি তার লাশ পেয়েছিলেন। তার থেকেই আমার গর্ভে সন্তান আসে। সেই সন্তান ভূমিষ্ট হওয়ার পর তাকেও সেই স্থানে ফেলে আসার নির্দেশ দেই, যেখানে তার পিতাকে ফেলে আসা হয়েছিলো। আল্লাহর শপথ ! এই হলো সত্য ঘটনা।


হযরত উমর রা. বললেন, বেটী ! তুমি সত্য বলেছো। এরপর হযরত উমর রা. মহিলার জন্য দোয়া করে বেরিয়ে আসলেন। আসার সময় তার পিতাকে বললেন, তোমার মেয়েটা বড়োই বুদ্ধিমান ও নেককার।


খলীফা নির্বাচিত হবার পর হযরত উমর (রা.)-এর ভাষণ


হযরত উমর (রা.) খলীফা নির্বাচিত হবার পর জাতীর উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন। তাঁর বক্তব্য ছিল,


“তোমাদের ধন- সম্পদে আমার অধিকার ততটুকু, যতটুকু অধিকার স্বীকৃত হয় ইয়াতীমের সম্পদে তার অভিভাবকের জন্য। আমি যদি ধনী ও স্বচ্ছল অবস্থায় থাকি, তবে আমি কিছুই গ্রহণ করব না। আর আমি যদি দরিদ্র হয়ে পড়ি তবে প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী সম্পদ গ্রহণ করব।


হে মানবমান্ডলী! আমার উপর তোমাদের কতগুলো অধিকার রয়েছে, আমার পক্ষ থেকে তা আদায় করা কর্তব্য। প্রথমতঃ দেশের রাজস্ব ও গনীমতের মাল, তা যেনো অহেতুক ব্যয় না হয়।


দ্বিতীয়ত, তোমাদের জীবিকার মান উন্নয়ন ও দেশের সীমান্ত রক্ষা আমার দায়িত্ব। আমার প্রতি তোমাদের এই অধিকারও রয়েছে যে, আমি তোমাদেরকে কখনো বিপদে ফেলব না।” তিনি আরও বলেছিলেন,


“তোমাদের যে কেউ আমার মধ্যে নীতি- বিচ্যুতি দেখতে পাবে, সে যেন আমাকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে চেষ্টা করে।”


উপস্থিত শ্রোতৃবৃন্দ হতে এক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে বলল, আল্লাহর শপথ! আপনার মধ্যে আমরা কোন নীতি- বিচ্যুতি দেখতে পেলে এই তীব্রধার তরবারি দ্বারা তা ঠিক করে দেব।”


এই হলো ইসলামের শাসন ব্যবস্থা।


হযরত ওমর (রাঃ) এবং তাঁর ওয়াদা


খলিফা হযরত ওমর (রাঃ) এর সময়কার একটি ঘটনা। পারস্যের নিহাওয়ান্দ প্রদেশের শাসনকর্তা হরমুযান। পর পর অনেকগুলো যুদ্ধেমুসলমানদের বিরুদ্ধে লড়বার পর এবং অগনিত মুসলমানকে নিজ হাতে হত্যা করার পরতিনি অবশেষে মুসলমানদের হাতে বন্ধী হলেন । হরমুযান ভাবলেন , খলিফা ওমর (রাঃ) নিশ্চয়ই তার প্রানদন্ডের হুকুম দেবেন, না হয় অন্ততঃ তাকে গোলাম হিসাবে কোথাও বিক্রি করে দেবেন। কিন্তু হযরত ওমর (রাঃ) বিশেষ কর দেওয়ার ওয়াদায় হরমুযানকে ছেড়ে দিলেন।


হরমুযান নিজ রাজ্যে ফিরে ওয়াদার কথা ভুলে গেলেন। অনেক টাকা-পয়সা ও বিরাটসৈন্য সমাবেশ নিয়ে তিনি আবার মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষনা করলেন। তুমুল যুদ্ধ শুরু হলো ।অবশেষে হনমুযান পরাজিত হয়ে আবার মুসলমানদের হাতে বন্দী হলেন।তাকে হযরত ওমর (রাঃ) এর দরবারে হাজির করা হলে খলিফা জিজ্ঞেস করলেন,


আপনিই কি কুখ্যাত নিহাওয়ান্দ শাসনকর্তা হরমুযান?


হ্যাঁ খলিফা , আমিই নিহাওয়ান্দ এর অধিপতি হরমুযান।


আপনিই বার বার আরবের মুসলিম শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষনা করেছেন এবং বার বার অন্যায় যুদ্ধের কারন ঘটিয়েছেন?


এ কথা সত্যি যে, আমি আপনার অধীনতা স্বীকার করতে রাজী হইনি, তাই বার বার যুদ্ধ করতে হয়েছে।


কিন্তু এ কথা কি মিথ্যে যে, আপনাকে পরাজিত ও বন্দী করার পরও আপনারপ্রস্তাবানুসারে সোলেহনামার শর্ত মতে আপনাকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বার বার আপনি সোলেহনামার শর্ত ভংগ করেছেন এবং অন্যায় যুদ্ধে মুসলমানদেরকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছেন?


এ কথা মিথ্যা নয়।


আপনি কি জানেন আপনার কি সাজা হবে?


জানি, আমার সাজা মুত্যু এবং আমি সেজন্য প্রস্তত আছি।


এবং এই মুহুর্তেই?


তাও বেশ জানি।


তা হলে আপনার যদি কোন শেষ বাসনা থাকে তা প্রকাশ করতে পারেন।


খলিফা, মৃত্যুর আগে আমি শুধুই এক বাটি পানি খাব।


খলিফার হুকুমে বাটিতে পানি এল। হরমুযানের হাতে দেওয়া হলে খলিফা


বললেন,


আপনি সাধ মিটিয়ে পানি খেয়ে নিন।


আমার শুধুই ভয় হয় পানি খাওয়ার সময়ই জল্লাদ না এক কোপে আমার


মাথাটা দেহ থেকে আলাদা না করে দেয়।


না হরমুযান, আপনার কোনই ভয় নেই। আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি, এই পানি খাওয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত কেউ আপনাকে কতল করবে না ।


খলিফা, আপনি বলেছেন এই পানি পান করা শেষ না হওয়া পর্যন্ত কেউ আমায় কতল করবে না। ( বাটির পানি মাটিতে ফেলে দিয়ে) সত্যি ?


এ পানি আর আমি খাচ্ছি না এবং তাই আপনার কথা মত কেউই আমাকে আর কতল করতে পারবে না।


চমৎকৃত হযরত ওমর (রাঃ) খানিক চুপ করে থেকে হেসে ফেললেন।


বললেন, হরমুযান: আপনি সত্যিই একটি নয়া উপায় বের করেছেন নিজেকে রক্ষা করার জন্যে। কিন্তু ওমরও যে আপনাকে কথা দিয়েছে তার খেলাপ হবে না। আপনি আযাদ, আপনি নির্ভয়ে নিজ রাজ্যে চলে যান।


হরমুযান চলে গেলেন। অল্পদিন পরে বহু সংখ্যক লোক নিয়ে আবার এলেন।খলিফা হযরত ওমর (রাঃ) এর দরবারে হাজির হয়ে বললেন,


আমিরুল মু’মিনিন! হরমুযান আবার এসেছে। এবার সে এসেছে বিদ্রোহীর বেশে নয়, এক নব জীবনের সন্ধানে। আপনি তাকে তার অনুচরবর্গসহ ইসলামে দীক্ষিত করুন। হরমুযান আর বলতে পারলেন না। তার কন্ঠ রুদ্ধ হয়ে এলো।


হযরত ওমর (রাঃ) দেখলেন, লৌহমানব হরমুযানের দু’চোখ পানিতে হলহল করছে । হরমুযানকে তিনি আলিংগন করলেন।


ওমর (রাঃ)-এর একটি ভাষণ


ইসলামের দ্বিতীয় খলীফা ওমর ফারূক (রাঃ) জীবনের শেষ হজ্জ সমাপনের পর মসজিদে নববীতে এক ঐতিহাসিক ভাষণ প্রদান করেন। এ সম্পর্কে নিম্নোক্ত হাদীছ।–


ইবনু আববাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি মুহাজিরদের কতক লোককে পড়াতাম। তাদের মধ্যে আব্দুর রহমান ইবনু আওফ (রাঃ) ছিলেন অন্যতম। একবার আমি তার মিনার বাড়িতে ছিলাম। তখন তিনি ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ)-এর সঙ্গে হজ্জে ছিলেন। এমন সময় আব্দুর রহমান (রাঃ) আমার কাছে ফিরে এসে বললেন, যদি আপনি ঐ লোকটিকে দেখতেন, যে লোকটি আজ আমীরুল মুমিনীন-এর কাছে এসেছিল এবং বলেছিল, হে আমীরুল মুমিনীন! অমুক ব্যক্তির ব্যাপারে আপনার কিছু করার আছে কি? যে লোকটি বলে থাকে যে, যদি ওমর মারা যান তাহ’লে অবশ্যই অমুকের হাতে বায়‘আত করব। আল্লাহ্র কসম! আবূবকরের বায়‘আত আকস্মিক ব্যাপারই ছিল। ফলে তা হয়ে যায়। এ কথা শুনে তিনি ভীষণভাবে রাগান্বিত হ’লেন। তারপর বললেন, ইনশাআল্লাহ সন্ধ্যায় আমি অবশ্যই লোকদের মধ্যে দাঁড়াব আর তাদেরকে ঐসব লোক থেকে সতর্ক করে দিব, যারা তাদের বিষয়াদি আত্মসাৎ করতে চায়।


আব্দুর রহমান (রাঃ) বলেন, তখন আমি বললাম, হে আমীরুল মুমিনীন! আপনি এমনটা করবেন না। কারণ হজ্জের মওসুম নিম্নস্তরের ও নির্বোধ লোকদেরকে একত্রিত করে। আর এরাই আপনার নৈকট্যের সুযোগে প্রাধান্য বিস্তার করে ফেলবে, যখন আপনি লোকদের মধ্যে দাঁড়াবেন। আমার ভয় হচ্ছে, আপনি যখন দাঁড়িয়ে কোন কথা বলবেন, তখন তা সব জায়গায় তাড়াতাড়ি ছড়িয়ে পড়বে। আর তারা তা ঠিকভাবে বুঝে উঠতে পারবে না। আর সঠিক রাখতেও পারবে না। সুতরাং মদীনায় পৌঁছা পর্যন্ত অপেক্ষা করুন। আর তা হ’ল হিজরত ও সুন্নাতের কেন্দ্রস্থল। ফলে সেখানে জ্ঞানী ও সুধীবর্গের সঙ্গে মিলিত হবেন। আর যা বলার তা দৃঢ়তার সঙ্গে বলতে পারবেন। জ্ঞানী ব্যক্তিরা আপনার কথাকে সঠিকভাবে বুঝতে পারবে ও সঠিক ব্যবহার করবে। তখন ওমর (রাঃ) বললেন, জেনে রেখো! আল্লাহ্র কসম! ইনশাআল্লাহ আমি মদীনায় পৌঁছার পর সর্বপ্রথম এ কাজটি নিয়ে ভাষণের জন্য দাঁড়াব।


ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, আমরা যিলহজ্জ মাসের শেষ দিকে মদীনায় ফিরলাম। যখন জুম‘আর দিন এল, সূর্য অস্ত যাওয়ার উপক্রম হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমি মসজিদে গেলাম। পৌঁছে দেখি, সাঈদ ইবনু যায়েদ ইবনে আমর ইবনে নুফায়েল (রাঃ) মিম্বরের গোড়ায় বসে আছেন, আমিও তার পাশে এমনভাবে বসলাম যেন আমার হাঁটু তার হাঁটু স্পর্শ করছে। অল্পক্ষণের মধ্যে ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ) বেরিয়ে আসলেন। আমি যখন তাঁকে সামনের দিকে আসতে দেখলাম, তখন সাঈদ ইবনু যায়েদ ইবনে আমর ইবনে নুফায়েলকে বললাম, আজ সন্ধ্যায় অবশ্যই তিনি এমন কিছু কথা বলবেন, যা তিনি খলীফা হওয়া থেকে আজ পর্যন্ত বলেননি। কিন্তু তিনি আমার কথাটি উড়িয়ে দিলেন এবং বললেন, আমার মনে হয় না যে, তিনি এমন কোন কথা বলবেন, যা এর আগে বলেননি। এরপর ওমর (রাঃ) মিম্বরের উপরে বসলেন। যখন মুয়াযযিন আযান থেকে ফারেগ হয়ে গেলেন তখন তিনি দাঁড়ালেন। আর আল্লাহ্র যথোপযুক্ত প্রশংসা করলেন। তারপর বললেন, ‘আম্মাবা‘দ। আজ আমি তোমাদেরকে এমন কথা বলতে চাই, যা আমারই বলা কর্তব্য। হয়তবা কথাটি আমার মৃত্যুর নিকটবর্তী সময়ে হচ্ছে। তাই যে ব্যক্তি কথাগুলো ঠিকভাবে বুঝে সংরক্ষণ করবে সে যেন কথাগুলো ঐসব স্থানে পৌঁছে দেয় যেখানে তার সওয়ারী পৌঁছবে। আর যে ব্যক্তি কথাগুলো ঠিকভাবে বুঝতে আশংকাবোধ করছে আমি তার জন্য আমার ওপর মিথ্যা আরোপ করা ঠিক মনে করছি না। নিশ্চয়ই আল্লাহ মুহাম্মাদ (ছাঃ)-কে সত্য সহকারে পাঠিয়েছেন। আর তাঁর উপর কিতাব অবতীর্ণ করেছেন এবং আল্লাহ্র অবতীর্ণ বিষয়াদির একটি ছিল রজমের আয়াত। আমরা সে আয়াত পড়েছি, বুঝেছি, আয়ত্ত করেছি।


আল্লাহ্র রাসূল (ছাঃ) পাথর মেরে হত্যা করেছেন। আমরাও তাঁর পরে পাথর মেরে হত্যা করেছি। আমি আশংকা করছি যে, দীর্ঘকাল অতিবাহিত হবার পর কোন লোক এ কথা বলে ফেলতে পারে যে, আল্লাহ্র কসম! আমরা আল্লাহ্র কিতাবে পাথর মেরে হত্যার আয়াত পাচ্ছি না। ফলে তারা এমন একটি ফরয ত্যাগের কারণে পথভ্রষ্ট হবে, যা আল্লাহ অবতীর্ণ করেছেন। আল্লাহ্র কিতাব অনুযায়ী ঐ ব্যক্তির উপর পাথর মেরে হত্যা অবধারিত, যে বিবাহিত হবার পর যেনা করবে, সে পুরুষ হোক বা নারী। যখন সুস্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যাবে অথবা গর্ভ বা স্বীকারোক্তি পাওয়া যাবে। তেমনি আমরা আল্লাহ্র কিতাবে এও পড়তাম যে, তোমরা তোমাদের বাপ-দাদা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ো না। এটি তোমাদের জন্য কুফরী যে, তোমরা স্বীয় বাপ-দাদা থেকে বিমুখ হবে। জেনে রেখো! রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, তোমরা সীমা ছাড়িয়ে আমার প্রশংসা করো না, যেভাবে ঈসা ইবনু মারিয়ামের সীমা ছাড়িয়ে প্রশংসা করা হয়েছে। তোমরা বল, আল্লাহ্র বান্দা ও তাঁর রাসূল। এরপর আমার কাছে এ কথা পৌঁছেছে যে, তোমাদের কেউ এ কথা বলছে যে, আল্লাহ্র কসম! যদি ওমর মারা যায় তাহ’লে আমি অমুকের হাতে বায়‘আত করব। কেউ যেন এ কথা বলে ধোঁকায় না পড়ে যে আবূবকরের বায়‘আত ছিল আকস্মিক ঘটনা। ফলে তা সংঘটিত হয়ে যায়। জেনে রেখো! তা অবশ্যই এমন ছিল। তবে আল্লাহ আকস্মিক বায়‘আতের ক্ষতি প্রতিহত করেছেন। সফর করে সওয়ারীগুলোর ঘাড় ভেঙ্গে যায়- এমন স্থান পর্যন্ত মানুষের মাঝে আবূবকরের মত কে আছে? যে কেউ মুসলিমদের পরামর্শ ছাড়া কোন লোকের হাতে বায়‘আত করবে, তার অনুসরণ করা যাবে না এবং ঐ লোকেরও না, যে তার অনুসরণ করবে। কেননা উভয়েরই হত্যার শিকার হবার আশংকা রয়েছে। যখন আল্লাহ তাঁর নবী (ছাঃ)-কে ওফাত দিলেন, তখন আবূবকর (রাঃ) ছিলেন আমাদের মধ্যে সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি। অবশ্য আনছারগণ আমাদের বিরোধিতা করেছেন। তারা সকলে বাণী সা‘ঈদার চত্বরে মিলিত হয়েছেন। আমাদের থেকে বিমুখ হয়ে আলী, যুবায়ের ও তাঁদের সাথীরাও বিরোধিতা করেছেন। অপরদিকে মুহাজিরগণ আবূবকরের কাছে সমবেত হ’লেন। তখন আমি আবূবকরকে বললাম, হে আবূবকর! আমাদেরকে নিয়ে আমাদের ঐ আনছার ভাইদের কাছে চলুন। আমরা তাদের উদ্দেশ্যে রওনা হ’লাম। যখন আমরা তাদের নিকটবর্তী হ’লাম তখন আমাদের সঙ্গে তাদের দু’জন পুণ্যবান ব্যক্তির সাক্ষাৎ হ’ল। তারা উভয়েই এ বিষয়ে আলোচনা করলেন, যে বিষয়ে লোকেরা ঐকমত্য হয়েছিল। এরপর তারা বললেন, হে মুহাজির দল! আপনারা কোথায় যাচ্ছেন? তখন আমরা বললাম, আমরা আমাদের ঐ আনছার ভাইদের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়েছি। তারা বললেন, না, আপনাদের তাদের নিকট না যাওয়াই উচিত। আপনারা আপনাদের বিষয় সমাপ্ত করে নিন। তখন আমি বললাম, আল্লাহ্র কসম! আমরা অবশ্যই তাদের কাছে যাব। আমরা চললাম। অবশেষে বাণী সা‘ঈদার চত্বরে তাদের কাছে আসলাম। আমরা দেখতে পেলাম তাদের মাঝখানে এক লোক বস্ত্রাবৃত অবস্থায় রয়েছেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ঐ লোক কে? তারা জবাব দিল ইনি সা‘দ ইবনু ওবাদাহ। আমি জিজ্ঞেস করলাম, তার কী হয়েছে? তারা বলল, তিনি জ্বরে আক্রান্ত। আমরা কিছুক্ষণ বসার পরই তাদের খত্বীব উঠে দাঁড়িয়ে কালিমায়ে শাহাদাত পড়লেন এবং আল্লাহ্র যথোপযুক্ত প্রশংসা করলেন। তারপর বললেন, আম্মাবা‘দ। আমরা আল্লাহ্র (দ্বীনের) সাহায্যকারী ও ইসলামের সেনাদল এবং তোমরা হে মুহাজির দল! একটি ছোট দল মাত্র, যে দলটি তোমাদের গোত্র থেকে আলাদা হয়ে আমাদের কাছে পৌঁছেছে। অথচ এরা এখন আমাদেরকে মূল থেকে সরিয়ে দিতে এবং খিলাফত থেকে বঞ্চিত করে দিতে চাচ্ছে। যখন তিনি নিশ্চুপ হ’লেন তখন আমি কিছু বলার ইচ্ছা করলাম। আর আমি আগে থেকেই কিছু কথা সাজিয়ে রেখেছিলাম, যা আমার কাছে ভাল লাগছিল। আমি ইচ্ছা করলাম যে, আবূবকর (রাঃ)-এর সামনে কথাটি পেশ করব। আমি তাঁর ভাষণ থেকে সৃষ্ট রাগকে কিছুটা ঠান্ডা করতে চাইলাম। আমি যখন কথা বলতে চাইলাম তখন আবূবকর (রাঃ) বললেন, তুমি থাম। আমি তাঁকে রাগান্বিত করাটা পসন্দ করলাম না। তাই আবূবকর (রাঃ) কথা বললেন, আর তিনি ছিলেন আমার চেয়ে সহনশীল ও গম্ভীর। আল্লাহ্র কসম! তিনি এমন কোন কথা বাদ দেননি যা আমি সাজিয়ে রেখেছিলাম। অথচ তিনি তাৎক্ষণিকভাবে ঐরকম বরং তার থেকেও উত্তম কথা বললেন। অবশেষে তিনি কথা বন্ধ করে দিলেন।


এরপর আবার বললেন, তোমরা তোমাদের ব্যাপারে যেসব উত্তম কাজের কথা বলেছ আসলে তোমরা এর উপযুক্ত। তবে খিলাফতের ব্যাপারটি কেবল এই কুরাইশ বংশের জন্য নির্দিষ্ট। তারা হচ্ছে বংশ ও আবাসভূমির দিক দিয়ে সর্বোত্তম আরব। আর আমি এ দু’জন হ’তে যে কোন একজনকে তোমাদের জন্য নির্ধারিত করলাম। তোমরা যে কোন একজনের হাতে ইচ্ছা বায়‘আত করে নাও। এরপর তিনি আমার ও আবূ ওবায়দাহ ইবনুল জাররাহ (রাঃ)-এর হাত ধরলেন। তিনি আমাদের মাঝখানেই বসা ছিলেন। আমি তাঁর এ কথা ব্যতীত যত কথা বলেছেন কোনটাকে অপসন্দ করিনি। আল্লাহ্র কসম! আবূবকর যে জাতির মধ্যে বর্তমান আছেন সে জাতির উপর আমি শাসক নিযুক্ত হবার চেয়ে এটাই শ্রেয় যে, আমাকে পেশ করে আমার ঘাড় ভেঙ্গে দেয়া হবে, ফলে তা আমাকে কোন গুনাহের কাছে আর নিয়ে যেতে পারবে না। হে আল্লাহ! হয়ত আমার আত্মা আমার মৃত্যুর সময় এমন কিছু আকাঙ্ক্ষা করতে পারে, যা এখন আমি পাচ্ছি না। তখন আনছারদের এক ব্যক্তি বলে উঠল, আমি এ জাতির অভিজ্ঞ ও বংশগত সম্ভ্রান্ত। হে কুরাইশগণ! আমাদের হ’তে হবে এক আমীর আর তোমাদের হ’তে হবে এক আমীর। এ সময় অনেক কথা ও হৈ চৈ শুরু হয়ে গেল। আমি এ মতবিরোধের দরুন শংকিত হয়ে পড়লাম। তাই আমি বললাম, হে আবূবকর! আপনি হাত বাড়ান। তিনি হাত বাড়ালেন। আমি তাঁর হাতে বায়‘আত করলাম। মুহাজিরগণও তাঁর হাতে বায়‘আত করলেন। অতঃপর আনছারগণও তাঁর হাতে বায়‘আত করলেন। আর আমরা সা‘দ ইবনু ওবাদাহ (রাঃ)-এর দিকে অগ্রসর হ’লাম। তখন তাদের এক লোক বলে উঠল, তোমরা সা‘দ ইবনু ওবাদাকে জানে মেরে ফেলেছ। তখন আমি বললাম, আল্লাহ সা‘দ ইবনু ওবাদাকে হত্যা করেছেন। ওমর (রাঃ) বলেন, আল্লাহ্র কসম! আমরা সে সময়ের যরূরী বিষয়ের মধ্যে আবূবকরের বায়‘আতের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কোন কিছুকে মনে করিনি। আমাদের ভয় ছিল যে, যদি বায়‘আতের কাজ অসম্পন্ন থাকে, আর এ জাতি থেকে আলাদা হয়ে যাই তাহ’লে তারা আমাদের পরে তাদের কারো হাতে বায়‘আত করে নিতে পারে। তারপর হয়ত আমাদেরকে নিজ ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাদের অনুসরণ করতে হ’ত, না হয় তাদের বিরোধিতা করতে হ’ত। ফলে তা মারাত্মক বিপর্যয়ের কারণ হয়ে দাঁড়াত। অতএব যে ব্যক্তি মুসলিমদের পরামর্শ ছাড়া কোন ব্যক্তির হাতে বায়‘আত করবে তার অনুসরণ করা যাবে না। আর ঐ লোকেরও না, যে তার অনুসরণ করবে। কেননা উভয়েরই নিহত হওয়ার আশংকা আছে (বুখারী হা/৬৮৩০ ‘দন্ডবিধি’ অধ্যায়)।


এ হাদীছে আবূবকর (রাঃ)-এর বায়‘আত গ্রহণের পূর্বের অবস্থা বর্ণিত হয়েছে। আর এ বায়‘আত গ্রহণের মধ্য দিয়ে আনছার ও মুহাজিরদের মাঝে বিবদমান বাকবিতন্ডার অবসান ঘটে। এ হাদীছে একে অপরকে মেনে নেওয়ার যে দৃষ্টান্ত বিধৃত হয়েছে, তা থেকে আমাদেরকে শিক্ষা নিতে হবে। আল্লাহ আমাদের তাওফীক্ব দান করুন- আমীন!


ভয়াবহতা !


আনাস ইবনে মালিক (রাঃ) বলেন, আরবরা সফরে গেলে একে অপরের খিদমত করত। আবুবকর ও ওমর (রাঃ)-এর সাথে একজন লোক ছিল যে তাদের খিদমত করত। তারা ঘুমিয়ে পড়লেন। অতঃপর জাগ্রত হলে লক্ষ করলেন যে, সে তাদের জন্য খাবার প্রস্ত্তত করেনি (বরং ঘুমিয়ে আছে)। ফলে একজন তার অপর সাথীকে বললেন, এতো তোমাদের নবী (ছাঃ)-এর ন্যায় ঘুমায়। অন্য বর্ণনায় আছে তোমাদের বাড়িতে ঘুমানোর ন্যায় ঘুমায় (অর্থাৎ অধিক ঘুমায় এমন ব্যক্তি)।


অতঃপর তারা তাকে জাগিয়ে বললেন, তুমি রাসূল (ছাঃ)-এর নিকট গমন করে তাঁকে বল যে, আবুবকর ও ওমর (রাঃ) আপনাকে সালাম প্রদান করেছেন এবং আপনার নিকট তরকারী চেয়েছেন। রাসূল (ছাঃ) তাকে বললেন, যাও, তাদেরকে আমার সালাম প্রদান করে বলবে যে, তারা তরকারী খেয়ে নিয়েছে। (একথা শুনে) তারা ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে নবী করীম (ছাঃ)-এর নিকট গমন করে বলল, হে আল্লাহ্র রাসূল (ছাঃ)! আমরা আপনার নিকট তরকারী চাইতে ওকে পাঠালাম। অথচ আপনি তাকে বলেছেন যে তারা তরকারী খেয়েছে। আমরা কি তরকারী খেয়েছি? তিনি (ছাঃ) বললেন, তোমাদের ভাইয়ের গোস্ত দিয়ে। যার হাতে আমার প্রাণ তার কসম করে বলছি, নিশ্চয়ই আমি তোমাদের উভয়ের দাঁতের মধ্যে তার গোস্ত দেখতে পাচ্ছি। তারা বললেন, আমাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করুন। তিনি (ছাঃ) বললেন, না বরং সেই তোমাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করবে’ (সিলসিলা ছহীহাহ হা/২৬০৮)।


আয়েশা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা আমি নবী করীম (ছাঃ)-কে বললাম, ‘আপনার জন্য ছাফিয়ার এই এই হওয়া যথেষ্ট’। কোন কোন বর্ণনাকারী বলেন, তাঁর উদ্দেশ্য ছিল ছাফিয়া বেঁটে। একথা শুনে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, ‘তুমি এমন কথা বললে, যদি তা সমুদ্রের পানিতে মিশানো হয়, তাহ’লে তার স্বাদ পরিবর্তন করে দেবে’।


আয়েশা (রাঃ) বলেন, একদা রাসূল (ছাঃ)-এর নিকট একটি লোকের পরিহাসমূলক ভঙ্গি করলাম। তিনি বললেন, ‘কোন ব্যক্তির পরিহাসমূলক ভঙ্গি নকল করি আর তার বিনিময়ে এত এত পরিমাণ ধনপ্রাপ্ত হই, এটা আমি আদৌ পসন্দ করি ন’ (আবুদাউদ হা/৪৮৭৭, সনদ ছহীহ)।


কায়স বলেন, আমর ইবনুল আছ (রাঃ) তার কতিপয় সঙ্গী-সাথীসহ ভ্রমণ করছিলেন। তিনি একটি মৃত খচ্চরের পাশ দিয়ে অতিক্রম করছিলেন, যা ফুলে উঠেছিল। তখন তিনি বললেন, আল্লাহর কসম! কোন ব্যক্তি যদি পেট পুরেও এটা খায়, তবুও তা কোন মুসলমানের গোশত খাওয়ার চেয়ে উত্তম’ (আদাবুল মুফরাদ হা/৭৩৬, সনদ ছহীহ)।


রাসূল (ছাঃ)-এর ঈলার ঘটনা


দাম্পত্য জীবন মানুষের জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সুম্পর্কের মাধ্যমে এ জীবন মধুময় হয়ে ওঠে। আবার দু’জনের মাঝে মনোমালিন্য ও ভুল বোঝাবুঝিতে এ জীবন দুঃখ-যাতনায় ভরে যায়। হাফছাহ (রাঃ) কর্তৃক আয়েশা (রাঃ)-এর কাছে নবী করীম (ছাঃ)-এর কথা ফাঁস করে দেয়ার কারণে রাসূল (ছাঃ) পত্নীগণের কাছে এক মাস না যাওয়ার শপথ করেন। সে সম্পর্কেই নিম্নোক্ত হাদীছ।–


আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি বহুদিন ধরে উৎসুক ছিলাম যে, আমি ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ)-এর নিকট জিজ্ঞেস করব, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর স্ত্রীগণের মধ্যে কোন দু’জনের ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলা এ আয়াত অবতীর্ণ করেছেন, ‘তোমার দু’জন যদি অনুশোচনা ভরে আল্লাহর দিকে আস (তবে তা তোমাদের জন্য উত্তম), তোমাদের অন্তর (অন্যায়ের দিকে) ঝুঁকে পড়েছে’ (আত-তাহরীম ৬৬/৪)।


এরপর একবার ওমর (রাঃ) হজ্জের জন্য রওয়ানা হ’লেন এবং আমিও তাঁর সঙ্গে হজ্জে গেলাম। ফিরে আসার পথে তিনি ইসতিনজার জন্য রাস্তা থেকে সরে গেলেন। আমি পানি পূর্ণ পাত্র হাতে তাঁর সঙ্গে গেলাম। তিনি ইসতিনজা করে ফিরে এলে আমি ওযূর পানি তাঁর হাতে ঢেলে দিতে লাগলাম। তিনি যখন ওযূ করছিলেন, তখন আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, হে আমীরুল মুমিনীন! নবী করীম (ছাঃ)-এর সহধর্মিনীগণের মধ্যে কোন দু’জন সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, ‘তোমরা দু’জন যদি আল্লাহর কাছে তওবা কর, তবে তোমাদের জন্য উত্তম। কেননা তোমাদের মন সঠিক পথ থেকে সরে গেছে’। জবাবে তিনি বললেন, হে ইবনু আববাস! আমি তোমার প্রশ্ন শুনে অবাক হচ্ছি। তাঁরা দু’জন তো আয়েশা (রাঃ) ও হাফছাহ (রাঃ)। এরপর ওমর (রাঃ) এ ঘটনাটি বর্ণনা করলেন, ‘আমি এবং আমার একজন আনছারী প্রতিবেশী যিনি উমাইয়াহ ইবনু যায়েদ গোত্রের লোক; তারা মদীনার উপকণ্ঠে বসবাস করত, আমরা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সঙ্গে পালাক্রমে সাক্ষাৎ করতাম। সে একদিন নবী করীম (ছাঃ)-এর দরবারে যেত, আরেক দিন আমি যেতাম। যখন আমি দরবারে যেতাম, ঐ দিন দরবারে অহী অবতীর্ণসহ যা ঘটত সবকিছুর খবর আমি তাকে দিতাম এবং সেও তেমনি খবর আমাকে দিত।


আমরা কুরাইশরা নিজেদের স্ত্রীগণের উপর প্রাধান্য বিস্তার করে রেখেছিলাম। কিন্তু আমরা যখন আনছারদের মধ্যে আসলাম, তখন দেখতে পেলাম, তাদের স্ত্রীগণ তাদের উপর প্রভাব বিস্তার করে আছে এবং তাদের উপর কর্তৃত্ব করে চলেছে। সুতরাং আমাদের স্ত্রীরাও তাদের দেখাদেখি সেরূপ ব্যবহার করতে লাগল।


একদিন আমি আমার স্ত্রীর প্রতি অসন্তুষ্ট হ’লাম এবং তাকে উচ্চৈঃস্বরে কিছু বললাম। সেও প্রতি উত্তর দিল। আমার কাছে এ রকম প্রতি উত্তর দেয়াটা অপসন্দনীয় হ’ল। সে বলল, আমি আপনার কথার পাল্টা উত্তর দিচ্ছি এতে অবাক হচ্ছেন কেন? আল্লাহর কসম! নবী করীম (ছাঃ)-এর স্ত্রীগণ তাঁর কথার মুখে মুখে পাল্টা উত্তর দিয়ে থাকেন এবং তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ আবার একদিন এক রাত পর্যন্ত কথা না বলে কাটান। ওমর (রাঃ) বলেন, এ কথা শুনে আমি ঘাবড়ে গেলাম এবং আমি বললাম, তাদের মধ্যে যারা এরূপ করেছে, তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এরপর আমি আমার কাপড় পরলাম এবং আমার কন্যা হাফছার ঘরে প্রবেশ করলাম। আমি বললাম, হাফছাহ! তোমাদের মধ্য থেকে কারো প্রতি রাসূল (ছাঃ) কি সারা দিন রাত পর্যন্ত অসন্তুষ্ট থাকেননি? সে উত্তর করল, হ্যাঁ। আমি বললাম, তুমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছ। তোমরা কি এ ব্যাপারে ভীত হচ্ছ না যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর অসন্তুষ্টির কারণে আল্লাহ অসন্তুষ্ট হবেন? পরিণামে তোমরা ধ্বংসের মধ্যে পড়বে। সুতরাং তুমি নবী করীম (ছাঃ)-এর কাছে অতিরিক্ত কোন জিনিস দাবী করবে না এবং তাঁর কথার প্রতিউত্তর করবে না। তাঁর সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করবে না। তোমার যদি কোন কিছুর প্রয়োজন হয়, তবে আমার কাছে চেয়ে নেবে। আর তোমার সতীন তোমার চেয়ে অধিক রূপবতী এবং রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর অধিক প্রিয় তা যেন তোমাকে বিভ্রান্ত না করে। এখানে সতীন বলতে আয়েশা (রাঃ)-কে বুঝানো হয়েছে।


ওমর (রাঃ) আরো বলেন, এ সময় আমাদের মধ্যে এ কথা ছড়িয়ে পড়েছিল যে, গাসসানের শাসনকর্তা আমাদের উপর আক্রমণ চালাবার উদ্দেশ্যে তাদের ঘোড়াগুলোকে প্রস্ত্তত করছে। আমার প্রতিবেশী আনছার তার পালার দিন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর খিদমতে থেকে রাতে ফিরে এসে আমার দরজায় করাঘাত করল এবং জিজ্ঞেস করল, আমি ঘরে আছি কি-না? আমি শংকিত অবস্থায় বেরিয়ে আসলাম। সে বলল, আজ এক বিরাট ঘটনা ঘটে গেছে। আমি বললাম, সেটা কী? গাসসানীরা কি এসে গেছে? সে বলল, না তার চেয়েও বড় ঘটনা এবং তা ভয়ংকর। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাঁর সহধর্মিনীগণকে তালাক দিয়েছেন। আমি বললাম, হাফছাহ তো ধ্বংস হয়ে গেল, ব্যর্থ হ’ল। আমি আগেই ধারণা করেছিলাম, খুব শিগগিরই এ রকম কিছু ঘটবে। এরপর আমি পোশাক পরলাম এবং ফজরের ছালাত নবী করীম (ছাঃ)-এর সঙ্গে আদায় করলাম। নবী করীম (ছাঃ) উপরের কামরায় (মাশরুবা) একাকী আরোহন করলেন, আমি তখন হাফছার কাছে গেলাম এবং তাকে কাঁদতে দেখলাম। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, কাঁদছ কেন? আমি কি তোমাকে এ ব্যাপারে আগেই সতর্ক করে দেইনি? নবী করীম (ছাঃ) কি তোমাদের সকলকে তালাক দিয়েছেন? সে বলল, আমি জানি না। তিনি ওখানে উপরের কামরায় একাকী রয়েছেন। আমি সেখান থেকেই বেরিয়ে মিম্বরের কাছে বসলাম। সেখানে কিছু সংখ্যক লোক বসা ছিল এবং তাদের মধ্যে অনেকেই কাঁদছিল। আমি তাদের কাছে কিছুক্ষণ বসলাম, কিন্তু আমার প্রাণ এ অবস্থা সহ্য করতে পারছিল না। সুতরাং যে উপরের কক্ষে নবী করীম (ছাঃ) অবস্থান করছিলেন আমি সেই উপরের কক্ষে গেলাম এবং তাঁর হাবশী কালো খাদেমকে বললাম, তুমি কি ওমরের জন্য নবী করীম (ছাঃ)-এর কাছে যাবার অনুমতি এনে দেবে? খাদেমটি গেল এবং নবী করীম (ছাঃ)-এর সঙ্গে কথা বলল। ফিরে এসে উত্তর করল, আমি নবী করীম (ছাঃ)-এর কাছে আপনার কথা বলেছি, কিন্তু তিনি নিরুত্তর আছেন। তখন আমি ফিরে এলাম এবং যেখানে লোকজন বসা ছিল সেখানে বসলাম। কিন্তু এ অবস্থা আমার কাছে অসহ্য লাগছিল। তাই আবার এসে খাদেমকে বললাম, তুমি কি ওমরের জন্য অনুমতি এনে দিবে? সে গেল এবং ফিরে এসে বলল, আমি নবী করীম (ছাঃ)-এর কাছে আপনার কথা বলেছি, কিন্তু তিনি নিরুত্তর ছিলেন। তখন আমি আবার ফিরে এসে মিম্বরের কাছে ঐ লোকজনের সঙ্গে বসলাম। কিন্তু এ অবস্থা আমার কাছে অসহ্য লাগছিল। পুনরায় আমি খাদেমের কাছে গেলাম এবং বললাম, তুমি কি ওমরের জন্য অনুমতি এনে দেবে? সে গেল এবং আমাকে উদ্দেশ্য করে বলতে লাগল, আমি আপনার কথা উল্লেখ করলাম, কিন্তু তিনি নিরুত্তর আছেন। যখন আমি ফিরে যাবার উদ্যোগ নিয়েছি, তখন খাদেমটি আমাকে ডেকে বলল, নবী করীম (ছাঃ) আপনাকে অনুমতি দিয়েছেন। এরপর আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকট প্রবেশ করে দেখলাম, তিনি খেজুরের চাটাইয়ের উপর চাদর বিহীন অবস্থায় খেজুরের পাতা ভর্তি একটি বালিশে ভর দিয়ে শুয়ে আছেন। তাঁর শরীরে চাটাইয়ের চিহ্ন পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। আমি তাঁকে সালাম করলাম এবং দাঁড়ানো অবস্থাতেই জিজ্ঞেস করলাম, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! আপনি কি আপনার স্ত্রীগণকে তালাক দিয়েছেন? তিনি আমার দিকে চোখ ফিরিয়ে বললেন, না। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! আপনি যদি শোনেন তাহ’লে বলি, আমরা কুরাইশগণ, মহিলাদের উপর আমাদের প্রতিপত্তি খাটাতাম, কিন্তু আমরা মদীনায় এসে দেখলাম, এখানকার পুরুষদের উপর নারীদের প্রভাব-প্রতিপত্তি বিদ্যমান। এ কথা শুনে নবী করীম (ছাঃ) মুচকি হাসলেন। তখন আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! যদি আপনি আমার কথার দিকে একটু নযর দেন। আমি হাফছার কাছে গেলাম এবং আমি তাকে বললাম, তোমার সতীনের রূপবতী হওয়া ও রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর প্রিয় পাত্রী হওয়া তোমাকে যেন ধোঁকায় না ফেলে। এর দ্বারা আয়েশাহ (রাঃ)-এর প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। নবী করীম (ছাঃ) আবার মুচকি হাসলেন। আমি তাঁকে হাসতে দেখে বসে পড়লাম। এরপর আমি তাঁর ঘরের চার দিকে তাকিয়ে দেখলাম। আল্লাহর কসম! কেবল তিনটি চামড়া ব্যতীত তাঁর ঘরে উল্লেখ করার মত কিছুই দেখতে পেলাম না। তারপর আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! দো‘আ করুন, আল্লাহ তা‘আলা যাতে আপনার উম্মতদের সচ্ছলতা দান করেন। কেননা পারসিক ও রোমানদের প্রাচুর্য দান করা হয়েছে এবং তাদের দুনিয়ার শান্তি প্রচুর পরিমাণে দান করা হয়েছে, অথচ তারা আল্লাহর ইবাদত করে না।


একথা শুনে হেলান দেয়া অবস্থা থেকে নবী করীম (ছাঃ) সোজা হয়ে বসে বললেন, হে খাত্ত্বাবের পুত্র! তুমি কি এখনো এ ধারণা পোষণ করছ? ওরা ঐ লোক, যারা উত্তম কাজের প্রতিদান এ দুনিয়ায় পাচ্ছে। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! আমার ক্ষমার জন্য আল্লাহর কাছে দো‘আ করুন। হাফছাহ (রাঃ) কর্তৃক আয়েশা (রাঃ)-এর কাছে কথা ফাঁস করে দেয়ার কারণে নবী করীম (ছাঃ) ঊনত্রিশ দিন তাঁর স্ত্রীগণ থেকে আলাদা থাকেন। নবী করীম (ছাঃ) বলেছিলেন, আমি এক মাসের মধ্যে তাদের কাছে যাব না তাদের প্রতি রাগের কারণে। তখন আল্লাহ তা‘আলা তাঁকে মৃদু ভৎর্সনা করেন। সুতরাং যখন ঊনত্রিশ দিন হয়ে গেল, নবী করীম (ছাঃ) সর্বপ্রথম আয়েশা (রাঃ)-এর কাছে গেলেন এবং তাঁকে দিয়েই শুরু করলেন। আয়েশা (রাঃ) তাঁকে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! আপনি কসম করেছেন যে, এক মাসের মধ্যে আমাদের কাছে আসবেন না; কিন্তু এখন তো ঊনত্রিশ দিনেই এসে গেলেন। আমি প্রতিটি দিন এক এক করে হিসাব করে রেখেছি। নবী করীম (ছাঃ) বললেন, ঊনত্রিশ দিনেও মাস হয়। নবী করীম (ছাঃ) বলেন, এ মাস ২৯ দিনের। আয়েশা (রাঃ) আরও বলেন, ঐ সময় আল্লাহ তা‘আলা এখতিয়ারের আয়াত অবতীর্ণ করেন, ‘যাতে নবী করীম (ছাঃ)-এর বিবিগণকে দুনিয়া বা আখিরাত এ দু’টোর যে কোন একটিকে বেছে নেয়ার জন্য বলা হয়েছে’ (আহযাব ২৮) এবং তিনি তাঁর স্ত্রীগণের মধ্যে আমাকে দিয়েই শুরু করেন এবং আমি তাঁকেই গ্রহণ করি। এরপর তিনি অন্য স্ত্রীগণের অভিমত চাইলেন। সকলেই তাই বলল, যা আয়েশা (রাঃ) বলেছিলেন (বুখারী হা/৪১৯১ ‘বিবাহ’ অধ্যায়)।


রাসূলের স্ত্রীগণের দাবীর প্রেক্ষিতে তিনি তাদের নিকটে এক মাস না যাওয়ার কথা বলেন। মাস পূর্ণ হ’লে তিনি তাদের নিকটে যান। এদ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, স্ত্রীদের দাবী সঙ্গত না হ’লে বা তাদের শাসনের উদ্দেশ্যে তাদের থেকে পৃথক থাকা যায়। আল্লাহ আমাদেরকে এ হাদীছ থেকে শিক্ষা গ্রহণের তাওফীক দিন-আমীন!


১ম অংশ


মুসলমানদের নাহাওয়ান্দ বিজয়।


যিয়াদ বিন জুবায়ের বিন হাইয়্যা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমার পিতা আমার নিকট বর্ণনা করেছেন যে, ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ) হারমুযানকে (বন্দি পারসিক সেনাপতি) বললেন, তুমি যখন নিজেকে আমার তুলনায় দুর্বল ভেবেই নিয়েছ, তখন আমাকে উপদেশমূলক কিছু কথা বল। তাকে তিনি এ কথাও বললেন যে, তোমার যা ইচ্ছা তাই বল, তোমার কোন ক্ষতি হবে না। অতঃপর তিনি তাকে জীবনের নিরাপত্তবা দান করলেন। তখন হারমুযান বলল, হ্যাঁ, বর্তমানে পারসিক সেনাবাহিনীর তিনটি ভাগ রয়েছে। শিরদেশ বা অগ্রবর্তী দল এবং দু’টি ডানা বা দল। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, অগ্রবর্তী দল এখন কোথায়? সে বলল, তারা বুনদারের অধীনে নাহাওয়ান্দে অবস্থান করছে। তার সাথে রয়েছে কিসরার জেনারেলগণ ও ইস্পাহানের অধিবাসীগণ। তিনি বললেন, আর ডানা দু’টো (অর্থাৎ অন্য দু’টি দল) কোথায় আছে? হারমুযান একটা জায়গার নাম বলেছিল কিন্তু আমি তা ভুলে গিয়েছি। হারমুযান তাঁকে এটাও বলল, আপনি দল দু’টো কেটে ফেলুন, দেখবেন শিরদেশ বা মাথা আপনা থেকেই দুর্বল হয়ে পড়বে। ওমর (রাঃ) তাকে বললেন, আল্লাহর শত্রু, তুই অসত্য বলেছিস। আমি বরং ওদের মাথা ধ্বংসের সিদ্ধান্ত নিচ্ছি, যাতে আল্লাহ তা বিচ্ছিন্ন করে দেন। যখন আল্লাহ আমার পক্ষ থেকে মাথাটা কেটে দিবেন তখন দল দু’টো এমনিতেই কাটা পড়ে যাবে। অতঃপর ওমর (রাঃ) নিজেই উক্ত বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রায় বের হওয়ার অভিমত প্রকাশ করেন। কিন্তু তাঁরা (উপদেষ্টামন্ডলী/মুসলিমজনতা) তাঁকে বলল, হে আমীরুল মুমিনীন, আমরা আপনাকে আল্লাহর কথা স্মরণ করতে বলছি। আপনি যদি নিজে এই অনারব বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে যান আর (আল্লাহ না করুন) আপনি যদি শাহাদাত বরণ করেন, তাহ’লে মুসলমানদের মধ্যে শৃঙ্খলা বলে কিছু থাকবে না। তার চেয়ে আপনি বরং অনেকগুলো সেনাদল প্রেরণ করুন। তিনি তখন মদীনাবাসীদের একটি দল প্রেরণ করলেন, যাদের মাঝে ছিলেন আব্দুল্লাহ ইবনু ওমর (রাঃ)। আরও প্রেরণ করলেন আনছার ও মুহাজিরদের একটি দল। সেই সঙ্গে তিনি আবু মূসা আশ‘আরী (রাঃ)-কে বছরার সেনাদল এবং হুযায়ফা ইবনুুল ইয়ামান (রাঃ)-কে কুফার সেনাদল নিয়ে নাহাওয়ান্দে সকলকে জমায়েত হতে পত্র লিখলেন। তিনি একথাও লিখে দিলেন যে, তোমরা সব দল একত্রিত হলে তোমাদের আমীর হবে নু‘মান ইবনু মুকাররিন মুযানী। যখন তারা সবাই নাহাওয়ান্দে সমবেত হলেন তখন বুনদার (আলাজ) তাঁদের নিকট এই মর্মে আবেদন জানিয়ে একজন দূত পাঠাল যে, হে আরব জাতি, তোমরা আমাদের নিকট পারস্পরিক আলোচনার জন্য একজন লোক পাঠাও। লোকেরা তখন মুগীরাহ ইবনু শু‘বাকে এজন্য মনোনীত করল। আমার (বর্ণনাকারীর) পিতা জুবায়ের (রাঃ) বলেন, আমার চোখে এখনও যেন সেই দৃশ্য ভাসছে- লম্বা, এলোমেলো কেশবিশিষ্ট, এক চোখওয়ালা একজন (দুর্বল) লোক যাচ্ছেন। তিনি তার নিকট গিয়ে যখন আলোচনা শেষে ফিরে এলেন তখন আমরা তাঁকে বৃত্তান্ত জিজ্ঞেস করলাম। তিনি আমাদের বললেন, আমি গিয়ে দেখলাম আলাজ (বুনদার) তার পারিষদবর্গের সাথে পরামর্শ করছে- তোমরা এই আরবীয়র বিষয়ে কী করতে বল? আমরা কি তার সামনে আমাদের জাঁকজমক, ঠাটবাট, ক্ষমতার আড়ম্বর তুলে ধরব, নাকি তাকে আমাদের অনাড়ম্বর সাদামাটা অবস্থা দেখাব এবং আমাদের বিত্তবৈভব ও শক্তিমত্তার দিকটা তার থেকে আড়াল করে রাখব? তারা বলল, না বরং আমাদের যে ঐশ্বর্য ও শক্তি সামর্থ্য আছে তার সেরাটাই তার সামনে তুলে ধরতে হবে। অতঃপর আমি যখন তাদের দেখা পেলাম তখন তাদের যুদ্ধের অস্ত্রশস্ত্র বল্লম, ঢাল ইত্যাদি আমার দৃষ্টিগোচর হ’ল। সেগুলো এতই জাক-জমকপূর্ণ ছিল যে, চোখে ধাঁধা লেগে যাচ্ছিল।


আলাজের পারিষদবর্গকে আমি তার মাথা বরাবর দাঁড়িয়ে থাকতে দেখতে পেলাম। সে ছিল স্বর্ণ নির্মিত চেয়ারে বসা। তার মাথায় মুকুট শোভা পাচ্ছিল। আমি আমার মত হেঁটে তার কাছে পৌঁছলাম এবং তার সাথে চেয়ারে আসন গ্রহণের জন্য আমার মাথা একটু নিচু করলাম। কিন্তু আমাকে বাধা দেওয়া হল এবং ধমক দেওয়া হল। আমি তখন বললাম, দূতদের সাথে তো এমন অশোভন আচরণ করা বিধেয় নয়। তারা তখন আমাকে বলল, আরে তুই তো একটা কুকুর! একজন রাজার সাথে তুই কি বসতে পারিস? আমি বললাম, তোমাদের মাঝে এই লোকটার (বুনদারের) যে মর্যাদা, আমি আমার জাতির মাঝে তার থেকেও বেশী মর্যাদার অধিকারী। এবার বুনদার আমাকে ধমক দিয়ে বলল, আরে বস। আমি তখন বসে পড়লাম। একজন দোভাষী তার কথা আমাকে অনুবাদ করে দিল। সে বলল, হে আরব জাতি, তোমরা মানবজাতির মাঝে সবচেয়ে বেশী ক্ষুধার ক্লেশভোগী, তোমাদের মত হতভাগাও আর দ্বিতীয় নেই, তোমরা এতই নোংরা দুর্গন্ধযুক্ত যে এ ভুবনে তার জুড়ি নেই, বাড়ি-ঘরের সঙ্গেও তোমাদের দূরতম কোন সম্পর্ক নেই (তোমরা মরুচারী যাযাবর বেদুঈন)। সব রকম কল্যাণ থেকে তোমরা বহু দূরে অবস্থিত। এখন আমার চারপাশে যে জেনারেলদের দেখছ, এদেরকে আমি কেবল এই হুকুমই দেব যে, তারা তীরধনুক ও অন্যান্য যুদ্ধাস্ত্রের দ্বারা তোমাদের গায়ের দুর্গন্ধ দূর করে তোমাদেরকে একেবারে শায়েস্তা করে দেবে। কারণ তোমরা দুর্গন্ধযুক্ত (অর্থাৎ তারা তোমাদেরকে মেরে ফেলবে)। এখন যদি তোমরা আমাদের এলাকা ছেড়ে চলে যাও তোমাদের রাস্তা পরিষ্কার করে দেওয়া হবে। আর যদি না যেতে চাও তবে মৃত্যুর ঠিকানাতেই আমরা তোমাদের আবাস গড়ে দেব। (এবার মুগীরা (রাঃ)-এর বলার পালা)। মুগীরা (রাঃ) বলেন, আমি তখন আল্লাহ তা‘আলার প্রশংসা ও গুণকীর্তন করলাম। তারপর বললাম, আল্লাহর কসম, আমাদের গুণ ও অবস্থা বর্ণনায় তুমি একটুও ভুল করনি। আসলেই বাড়িঘর তথা সভ্যতার থেকে আমরা সকল মানব জাতির তুলনায় অনেক দূরে ছিলাম। ক্ষুধার তীব্র জ্বালাও আমরা সব মানুষের থেকে বেশী সয়েছি, দুর্ভাগ্যের বোঝাও আমাদের সবচে বেশী বইতে হয়েছে, সব রকম কল্যাণ থেকে আমরা অনেক দূরে ছিলাম। শেষ অবধি আল্লাহ তা‘আলা আমাদের মাঝে একজন রাসূল পাঠালেন। তিনি আমাদেরকে দুনিয়াতে বিজয় এবং আখিরাতে জান্নাতের প্রতিশ্রুতি দিলেন। আমাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে সেই রাসূলের আগমন থেকে নিয়ে তাঁর (আল্লাহর) মহান কৃপায় কল্যাণ ও বিজয়ের সঙ্গে আমরা এখন পরিচিত হয়েছি। শেষাবধি আমরা তোমাদের দরজায় হাযির হয়েছি। আল্লাহর কসম, আমরা তোমাদের যে রাজ্য ও জীবন-জীবিকা দেখছি তাতে আমরা আর ঐ দুর্ভাগ্যের পানে কখনই ফিরে যাব না। হয় আমরা তোমাদের মালিকানাধীন যা আছে তা সব জয় করব, নয় তোমাদের দেশেই নিহত হব।


২য় অংশ


মুসলমানদের নাহাওয়ান্দ বিজয়।


বুনদার বলল, এই কানা লোকটা তার মনের কথা সত্যই তোমাদের বলেছে। অতঃপর আমি তার নিকট থেকে উঠে এলাম। আল্লাহর কসম, ইতোমধ্যে আমার চেষ্টায় আমি আলাজের মনে ভয় ধরাতে সক্ষম হয়েছি। এরপর আলাজ আমাদের নিকট দূত পাঠাল যে, তোমরা (দজলা নদী) পাড়ি দিয়ে নাহাওয়ান্দে আমাদের নিকট এসে যুদ্ধ করবে, নাকি আমরা পাড়ি দিয়ে তোমাদের নিকট গিয়ে যুদ্ধ করব? আমাদের সেনাপতি নু‘মান আমাদেরকে বললেন, তোমরা নদী পার হও। ফলে আমরা নদী পার হলাম। আমার পিতা বলেন, এ দিনের মত দৃশ্য আমি আর কখনো দেখিনি। আলাজের পারসিক বাহিনী যেন লোহার পাহাড় হয়ে ধেয়ে আসছিল। তারা পরস্পর অঙ্গীকারা বদ্ধ হয়েছিল যে, তারা আরবদের ভয়ে পলায়ন করবে না। তাদের একজনকে অন্য জনের সাথে জুড়ে দেওয়া হয়েছিল, যার সংখ্যা দাঁড়িয়েছিল সাত। তারা তাদের পেছনে কাঁটা তারের বেড়া দিয়ে রেখেছিল। তারা বলাবলি করছিল, আমাদের মধ্যে যে পালাতে চেষ্টা করবে সে লোহার কাঁটাতারে জড়িয়ে খুন হবে। মুগীরা ইবনু শু‘বা (রাঃ) তাদের সংখ্যাধিক্য দেখে বললেন, আজকের মত হতাশা আর কোন দিন লক্ষ করিনি। আমাদের শত্রুরা আজ ঘুম ত্যাগ করবে, তারা আগে আক্রমণ করবে না। আল্লাহর কসম, যদি দায়িত্ব আমার কাঁধে থাকত তাহ’লে আমি তাদের আগে আক্রমণ করতাম। এদিকে সেনাপতি নু‘মান (রাঃ) ছিলেন অধিক কাঁন্নাকাটি করা মানুষ। তিনি মুগীরা (রাঃ)-কে বললেন, আল্লাহ তা‘আলা যদি আপনাকে অনুরূপ অবস্থার মুখোমুখি করেন, তখন যেন তিনি আপনাকে দুঃখ-বেদনার মুখোমুখি না করেন এবং আপনার ভূমিকায় আপনাকে দোষী না বানান। আল্লাহর কসম! তাদের সাথে দ্রুত যুদ্ধে লিপ্ত হতে আমার একটাই বাধা , যা আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) থেকে লক্ষ করেছি। তিনি যখন যুদ্ধে যেতেন তখন দিনের পূর্ব ভাগে আক্রমণ করতেন না। যতক্ষণ না ছালাতের ওয়াক্ত হয়, বাতাস বইতে থাকে এবং যুদ্ধ অনুকূলে হয় ততক্ষণ তিনি আগবাড়িয়ে আক্রমণে যেতেন না। তারপর নু‘মান (রাঃ) এই বলে দো‘আ করলেন যে, হে আল্লাহ! আমি তোমার নিকট প্রার্থনা করছি। তুমি এমন বিজয় দ্বারা আমার চোখ ঠান্ডা করবে যাতে ইসলাম ও মুসলিমদের সম্মান এবং কুফর ও কাফিরদের লাঞ্ছনা নিহিত থাকবে। তার পরে তুমি শাহাদাতের অমিয় সুধা পানের মাধ্যমে আমার জীবনের অবসান ঘটাবে। দো‘আ শেষে তিনি বললেন, আল্লাহ তোমাদের উপর রহম করুন, তোমরা সবাই আমীন বল। আমরা বললাম, আমীন (হে আল্লাহ, কবুল কর)। দো‘আ করে তিনি কেঁদে ফেললেন, আমরাও কেঁদে ফেললাম। তারপর আক্রমণ কীভাবে শুরু হবে সে প্রসঙ্গে নু‘মান (রাঃ) বললেন, আমি যখন আমার পতাকা দুলাব তখন তোমরা অস্ত্র নিয়ে প্রস্ত্তত হবে। দ্বিতীয়বার যখন আমি পতাকা দুলাব তখন তোমরা তোমাদের বরাবর যে শত্রু থাকবে তার উপর হামলার প্রস্ত্ততি নেবে। তৃতীয়বার দুলালে প্রত্যেকেই যেন তার সামনাসামনি অবস্থিত শত্রুর উপর আল্লাহর বরকত কামনা করে আক্রমণ চালিয়ে যাবে।


অতঃপর যখন ছালাতের সময় হল এবং বাতাস বইতে লাগল তখন সেনাপতি আল্লাহু আকবার ধ্বনি করলেন, আমরাও তাঁর সাথে আল্লাহু আকবার বললাম। তিনি বললেন, আল্লাহর কসম, আল্লাহ চাহে তো এটি বিজয়ের বাতাস। আমি নিশ্চিত আশা করি যে, আল্লাহ আমাদের দো‘আ কবুল করবেন এবং আমাদের বিজয় অর্জিত হবে। এই বলে তিনি পতাকা দুলালেন। সৈন্যরা সবাই যুদ্ধের জন্য প্রস্ত্তত হল। তিনি দ্বিতীয় ও তৃতীয়বার পতাকা দুলালেন, তখন আমরা একযোগে প্রত্যেকেই নিজের সামনের জনের উপর আক্রমণ করলাম। মহান সেনাপতি নু‘মান (রাঃ) যুদ্ধের প্রারম্ভে বলেন, আমি নিহত হ’লে হুযায়ফা ইবনুুল ইয়ামান (রাঃ) দলপতি হবেন। যদি হুযায়ফা নিহত হন তবে অমুক (তারপর অমুক)। এভাবে তিনি সাত জনের নাম উল্লেখ করেন যাঁদের সর্বশেষ ব্যক্তি ছিলেন মুগীরা ইবনু শু‘বা (রাঃ)। আমার পিতা বলেন, আল্লাহর কসম, মুসলমানদের এমন একজনও আমার জানামতে ছিল না, যে নিহত কিংবা জয় ব্যতীত নিজ পরিবারে ফিরে যেতে আগ্রহী ছিল। প্রতিপক্ষ আমাদের বিপক্ষে স্থির দাঁড়িয়ে গেল। তখন আমরা কেবল লোহার উপর লোহার আঘাত ছাড়া আর কিছুই শুনতে পাচ্ছিলাম না। এতে করে মুসলমানদের মধ্য থেকে একটি বড় দল নিহত হ’ল কিন্তু যখন তারা আমাদের ধৈর্য ও দৃঢ়তা দেখতে পেল এবং বুঝতে পারল যে আমরা ফিরে যেতে ইচ্ছুক নই তখন তারা পিঠ টান দিল। তখন তাদের একজন লোক ঘায়েল হ’লে রশিতে আবদ্ধ সাত জনই পড়ে যাচ্ছিল এবং সবাই নিহত হচ্ছিল। আর পিছন থেকে লোহার কাঁটা তারের বেড়া তাদের প্রাণহানি ঘটাচ্ছিল। তখন নু‘মান (রাঃ) বললেন, তোমরা পতাকা নিয়ে সামনে এগিয়ে যাও। আমরা পতাকা নিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে থাকলাম, আর তাদের হত্যা ও পরাস্ত করতে লাগলাম। তারপর নু‘মান (রাঃ) যখন দেখলেন, আল্লাহ তা‘আলা তাঁর দো‘আ কবুল করেছেন এবং তিনি বিজয়ও দেখতে পেলেন ঠিক তখনই একটি তীর এসে তাঁর কোমরে বিঁধল, আর তাতেই তিনি শাহাদত বরণ করলেন।


এ সময় তাঁর ভাই মা‘কাল ইবনু মুকার্রিন এগিয়ে এসে একটি কাপড় দিয়ে তাঁকে ঢেকে দেন। তারপর তিনি পতাকা ধারণ করে এগিয়ে যান এবং বলেন, আল্লাহ তোমাদের উপর রহম করুন, তোমরা সামনে এগিয়ে চল। আমরা তখন এগিয়ে চললাম এবং তাদের পরাস্ত ও হত্যা করতে লাগলাম। তারপর আমরা যখন যুদ্ধ শেষ করলাম এবং লোকেরা এক জায়গায় জমা হ’ল তখন তারা বলল, আমাদের আমীর (সেনাপতি) কোথায়? তখন মা‘কাল বললেন, এই যে তোমাদের আমীর। আল্লাহ বিজয় দ্বারা তাঁর চোখকে ঠান্ডা করেছেন, আর তাঁর শেষ যাত্রায় শাহাদাত নছীব হয়েছে। তারপর লোকেরা হুযায়ফা ইবনুুল ইয়ামান (রাঃ)-এর হাতে বায়‘আত হ’ল।


রাবী বলেন, এদিকে ওমর ইবনুুল খাত্ত্বাব (রাঃ) মদীনায় বসে আল্লাহর কাছে দো‘আ করছিলেন। আর প্রসূতি যেমন সদ্যপ্রসূত সন্তানের কান্নার আওয়ায শোনার প্রতীক্ষা করে তেমন করে তিনি যুদ্ধের সংবাদ শোনার প্রতীক্ষা করছিলেন। ইত্যবসরে হুযায়ফা (রাঃ) একজন মুসলিমের হাতে ওমর (রাঃ)-এর নিকট বিজয় বার্তা লিখে পাঠালেন। সে তাঁর নিকট পৌঁছে যখন বলল, আমীরুল মুমিনীন, এমন একটা বিজয়ের সুসংবাদ গ্রহণ করুন, যার মাধ্যমে আল্লাহ ইসলাম ও মুসলমানদের সম্মানিত করেছেন এবং শিরক ও মুশরিকদের অপদস্থ করেছেন। তখন তিনি বললেন, তোমাকে কি নু‘মান পাঠিয়েছে? সে বলল, আমীরুল মুমিনীন, নু‘মান (রাঃ) পরপারে যাত্রা করেছেন। একথা শুনে ওমর (রাঃ) কেঁদে ফেললেন এবং ইন্নালিল্লাহ পড়লেন। তারপর বললেন, তোমার উপর রহম হোক, আর কে কে মারা গেছে? সে বলল, অমুক, অমুক- এভাবে সে বেশ কিছু লোকের নাম বলল, তারপর বলল। হে আমীরুল মুমিনীন, অন্য আরো অনেকে মারা গেছেন, যাদের আপনি চিনবেন না। ওমর (রাঃ) তখন কাঁদতে কাঁদতে বললেন, ওমর তাঁদের না চিনলেও তাঁদের কোন ক্ষতি নেই। কারণ আল্লাহ তা‘আলা তো তাঁদের অবশ্যই চিনবেন। (ইবনু হিববান হা/৪৭৫৬, বুখারী হা/৩১৫৯, ৩১৬০, সংক্ষিপ্তাকারে; তাবারানী, তারীখ ২/২৩৩-২৩৫; সিলসিলা ছহীহা হা/২৮২৬)।


১ম অংশ


দূর সাগরের ডাক ।


খলিফা হযরত উমর (রা)।


খলিফা হবার আগেও তিনি গরিব-দুঃখীদের খোঁজ খবর নিতেন। তাদের পাশে এসে দাঁড়াতেন।


গরিব-দুঃখীদের খবর নেবার জন্যে তাদের দুঃখ-কষ্ট দূর করার জন্য হযরত উমর (রা) রাতের গভীর মহল্লায়-মহল্লায় ঘুড়ে বেড়াতেন। একাকী। ঘুরতে ঘুরতে একবার তিনি মদীনার একপ্রান্তে এস পৌঁছুলেন।


সেই এলাকার একপাশে থাকেন এক অসহায় বুড়ি। দারুণ দুঃখ-কষ্টে বুড়ির দিন কাটে।


হযরত উমর (রা) বুড়ির দুঃখের কথা জেনে বিচলিত হয়ে পড়লেন। তাকে সাহায্য করার জন্য তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন। ভাবলেন, নিজের হাতেই তাকে সাহায্য করবেন।


পরদিন হযরত উমর (রা) একাকী চলে গেলেন বুড়ির বাড়িতে।


বুড়ির সাথে দেখা করলেন।


শুনলেন, কে একজন এসে তার কষ্ট দূর করে দিয়ে গেছেন।


অবাক হলেন হযরত উমর (রা)।


বড় আশর্যের কথঅ!


কে সেই ব্যক্তি, যিনি উমরের প্রতিদ্বন্দ্বী হতে চান? সে কোন ব্যক্তি, যিনি মানুষের সেবায় উমরকে পরাজিত করেন!


তাকে দেখার জন্যে অস্থির হয়ে পড়লেন হযরত উমর (রা)।


যে করেই হোক, তাকে খুঁজে বের করতেই হবে।– ভাবলেন তিনি।


প্রতিদিন তিনি লুকিয়ে দেখার চেষ্টা করেন। চেষ্টা করেন সেই ব্যক্তিকে খুঁজে বের করতে।


এভাবে কেটে যায় সময়। কেটে যায় প্রহর। কিন্তু পান না তার প্রার্থিত সেই ব্যক্তিকে।


আর কত অপেক্ষা করতে হবে? তিনি ভাবেন।


এক রাতে লুকিয়ে আছেন হযরত ওমর (রা)।


একটু পরেই তিনি দেখলেন, একজন ব্যক্তি এলেন বুড়ির বাড়িতে।


বুড়ির কাছে গিয়ে তিনি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলেন।


বুড়ি খুশি হলেন।


খুব ভালোকরে তাকিয়ে দেখলেন হযরত উমর (রা)।


দেখলেন, যিনি বুড়ির দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন, তিনি আর কেউ নন- হযরত আবু বকর (রা)।


দুই প্রতিদ্বন্দীর মুখোমুখি সাক্ষাৎ হলে দু’জনই হেসে উঠলেন। সে এক মধুর হাসি।


উমর (রা) বললেন, আল্লাহর দরবারে হাজার শোকর যে, স্বয়ং খলিফা ছাড়া আমি আর কারো কাছে পরাজিত হইনি।


এই হলেন প্রথম খলিফা হযরত আবু বকর (রা)।


হযরত আবু বকর (রা) ছিলেন রাসূলের (সা) সাহাবীদের মধ্যে অন্যতম। জ্ঞানে-পজ্ঞায় বিদ্যা-বুদ্ধিতে তিনি ছিলেন অসাধারণ।


হযরত আবু বকর ছিলেন অত্যন্ত দয়ালূ এবং সহনশীল।


নম্রতা, ভদ্রতা এবং বিনয় ছিল তার একান্ত ভূষণ।


ইসলামপূর্ব সময়ে সেই জাহেলি যুগেও হযরত আবু বকর ছিলেন চরিত্র, ব্যবহার আর আচরণগত দিক থেকে অনুকরণীয়।


জাহেলী সমাজের কোনো কালিমাই তাক কখনো স্পর্শ করতে পারেনি।


এ কারণে মক্কাবাসীরা তাকে শ্রদ্ধা করতো একান্ত হৃদয় থেকে।


আর বিশ্বাস করতো তাকে সর্বান্তকরণে।


কুরাইশদের মধ্যে তার মর্যাদা ছিল অনেক উচ্চে।


খুব ছোটকাল থেকে, সেই শৈশবকাল থেকেই আবু বকরের (রা) বন্ধুত্ব এবং গভীর সম্পর্ক ছিল রাসূলের (সা) সাথে।


বয়সের দিক থেকেও তারা ছিলেন প্রায় সমবয়সী। এক সাথে, একই পরিমণ্ডলে বেড়ে উঠেছিলেন দু’জন। ব্যবসা, বাণিজ্যেও যেতেন একই সাথে।


একবার ব্যবসা উপলক্ষে সিরিয়া যাচ্ছেন রাসুল (সা)।


তখন তাঁর বয়স বিশ বছর।


আর তাঁর সাথে বন্ধু আবু বকর। তার বয়স তখন আঠার।


সিরিয়া সীমান্তে পৌঁছে তারা ক্লান্ত হয়ে পড়লেন। একটু বিশ্রামের প্রয়োজন।


একটি গাছের নিচে বসে পড়লেন রাসুল (সা)।


তাঁর থেকে একটু দূরে গিয়ে এদিকে-ওদিক তাকিয়ে দেখছেন আবু বকর (রা)।


এমনি সময়ে তিনি দেখতে পেলেন একজন পাদ্রিকে। খ্রিস্টান পাদ্রির নাম- ‘বুহাইরা’ বা ‘নাসতুরা’।


পাদ্রির সাথে বেশ কিছুক্ষণ কথা হলো আবু বকরের। না, অন্য কোনো প্রসঙ্গে নয়। তাদের আলাপ ছিল ধর্মীয় বিষয়েল মধ্যে সীমাবদ্ধ।


আলাপের এক ফঁকে পাদ্রি জিজ্ঞেস করলেন, ঐখানে, ঐ গাছের নিচে বসে আছেন কে?


আবু বকর জবাব দিলেন, উনি মক্কার কুরাইশ গোত্রের মুহাম্মদ বিন আবদুল্লাহ!


নামটি শুনেই পাদ্রি একটু থমকে গেলেন।


তারপর বললেন, ঐ ব্যক্তি আরবের নবী হবেন।


পাদ্রির কথাটি শুনেই পাদ্রি একটু থমকে গেলেন।


তারপর বললেন, ঐ ব্যক্তি আরবদের নবী হবেন।


পাদ্রির কথাটি শুনেই আনন্দের এক অপার্থিব ঢেউ খেলে গেল আবু বকরের মধ্যে। তার দৃঢ় বিশ্বাস জন্মালো, হ্যাঁ- সত্যিই একদিন নবী হবেন আমার বন্ধু-মুহাম্মদ।


পাদ্রির কথাটি মিথ্যা ছিল না।


এতটুকু ভুল ছিল না তার ধারণায়।


সত্যিই একদিন আল্লাহর পক্ষথেকে নবুওয়াতের নিয়ামত হযরত মুহাম্মদ (সা)।


নবুওয়াত প্রাপ্তির পর যখনই রাসুল (সা) ইসলামের দাওয়াত দিলেন আবু বকরকে, আর সাথে সাথে তিনি তা কবুল করলেন।


রাসূলও (সা) বলতেন, ‘আমি যাকেই ইসলামের দাওয়াত দিয়েছি, একমাত্র আবু বকর ছাড়া প্রত্যেকের মধ্যে কিছু না কিছু দ্বিধার ভাব লক্ষ্য করেছি।’


হযরত আবু বকর (রা) ছিলেন বয়স্ক আজাদ লোকদের মধ্যে প্রথম মুসলমান।


ইসলাম গ্রহণের পর হযরত আবু বকর নিজেকে উৎসর্গ করে দেন আল্লাহর পথে।


রাসূলের (সা) প্রদর্শিত পথে।


তাঁর যাবতীয় সম্পদ এবং শক্তি কুরবানী করে দেন আল্লাহর রাস্তায়। হাসিমুখে।


দয়ার নবীজী (সা) যখন প্রকাশ্যে নবুওয়াতের ঘোষণা দিলেন, হযরত আবু বকরের কাছে তখন ছিল চল্লিশ হাজার দিরহাম।


মুহূর্তেই তিনি তার এই বিপুল অর্থ ওয়াক্‌ফ করে দিলেন ইসলামের জন্য। তার অর্থ দিয়েই দাসের শৃঙ্খল থেকে মুক্তি লাভ করে ইসলামের খেদমতে নিজেদেরকে উৎসর্গ করার সুযোগ পেয়েছিল হযরত বিলাল, খাব্বা, আম্বার, আম্মারের মা সুমাইয়্যা, সুহাইব, আবু ফুকাইহাসহ আরও অনেক দাস-দাসী।


হযরত আবু বকরের দান সম্পর্কে রাসূল (সা) বলতেন:


‘আমি প্রতিটি মানুষের ইহসান পরিশোধ করেছি। কিন্তু আবু বকরের ইহসানসমূহ এমন যে, তা পরিশোধ করতে আমি অক্ষম। তার প্রতিদান আল্লাহ দেবেন। তার অর্থ আমার উপকারে যেমন এসেছে, অন্যকারো অর্থ তেমন আসেনি।’


দয়ার নবীজীল মুখে মিরাজের কথা শুনে অনেকেই বিশ্বাস করতে দ্বিধান্বিত হন। কিন্তু আবু বকর তাহননি।


তিনি রাসূলের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন:


‘হে আল্লাহর নবী! আপনি কি জনগণকে বলেছেন যে, আপনি গতরাতে বাইতুল মাকদাস ভ্রমণ করেছেন?’


রাসূল (সা) বললেন, হ্যাঁ।


রাসূলের মুখ থেকে একথা শুনার সাথে সাথেই তিনি বললেন,


‘আপনি ঠিকই বলেছেন হে আল্লাহর রাসূল! আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, আপনি নিঃসন্দেহে আল্লাহর রাসূল।


২য় অংশ


দূর সাগরের ডাক ।


নবীজী (সা) বললেন:


‘হে আবু বক্কর, তুমি সিদ্দীক।’


কী অপূর্ব পুরষ্কার!


রাসূল (সা) হযরত আবু বকরের ‘সিদ্দীক’ উপাধিতে ভূষিত করলেন।


হযরত আবু বকর (রা) সারাটি জীবন রাসূলের (সা) সর্বপ্রথম গেলেন আবু বকরের বাড়িতে। তাকেই জানালেন সমস্ত ঘটনা। এবং কী আশ্চর্য! হযরত আবু বকরও রাসূলের (সা) সাথে হিজরত করার সৌভাদ্য লাভ করলেন।


হযরত খাদিজার (রা) ইন্তেকালের পর বিমর্ষ হয়ে পড়লেন রাসূল (সা)। এ সময়ে হযরত আবু বকর নিজের আদরের কন্যা হযরত আয়েশাকে(রা) বিয়ে দিলেন রাসূলের (সা) সাথে।


হিজরতের পর প্রতিটি অভিযানে হযরত আব বকর ছিলে মুসলিম বাহিনীর পতাকাবাহী।


তাবুক যুদ্ধ!


তাবুক অভিযানে হযরত আব বকর ছিলেন মুসলিম বাহিনীর পাতাকাবাহী। এই অভিযানের সময় তিনি রাসূলের (সা) আবেদনে সাড়া দিয়ে তার সকল অর্থ রাসূলের (সা) হাতে তুলে দেন।


অবাক হয়ে রাসূল (সা) জিজ্ঞেস করলেন,


‘ছেলে-মেয়েদের জন্য কিছু রেখেছো কি?’


জবাবে আবু বকর (রা) বললেন,


‘তাদের জন্য আল্লাহ এবং আল্লাহর রাসূলই যথেষ্ট।’


রাসূলের (সা) ওফাতের পর প্রথম খলিফা নির্বাচিত হলেন হযরত আবু বকর (রা)।


খলিফা নির্বাচিত হবার পর তিনি সমবেত মুহাজির ও আনসারদের উদ্দেশ্যে একটি ভাষণ দিলেন। সেই ঐতিহাসিক ভাষণটি ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেন:


‘আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধেই আমাকে খলিফা নির্বাচিত করা হয়েছে।


আল্লাহর কসম!


আমি চাচ্ছিলাম আপনাদের মধ্য থেকে অন্য কেউ এ দায়িত্ব গ্রহণ করুক।


আমি স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, আপনারা যদি চান আমার আচরণ রাসূলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আচরণের মত হোক, তাহলে আমাকে সেই পর্যায়ে পৌঁছার ব্যাপারে অক্ষম মনে করবেন। কারণ তিনি ছিলেন নবী। তিনি যাবতীয় ভুল-ত্রুটি থেকে পবিত্র ছিলেন। তাঁর মত আমার কোনো বিশেষ মর্যাদা নেই।


আমি একজন সাধারণ মানুষ। আপনাদের কোনো একজন সাধারণ ব্যক্তি থেকেও উত্তম হওয়ার দাবি আমি করতে পারি না।.. আপনারা যদি দেখেন আমি সঠিক কাজ করছি, তবে আমাকে সহযোগিতা করবেন। আর যদি দেখেন আমি বিপথগামী হচ্ছি, তাহলে আমাকে সতর্ক করে দেবেন।’


হযরত আবু বকর (রা) ছিলেন যেমনই কোমল, তেমনই আবার দৃঢ়। তার এই মহৎ চরিত্রের কারণে তিনি ছিলেন অনন্য।


রাসূলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ওফাতের পর হযরত আবুবকরের (রা) খিলাফতকালে মুসলিম উম্মাহর মধ্যে ঐক্য ও সংহতি বিরাজ করে। কিন্তু তার সবচেয়ে যে বড় অবদান তা হলো- পবিত্র আল -কোরআন সঙ্কলন ও সংরক্ষণ।


হযরত আবু বকর (রা) ছিলেন যেমনই মর্যাদাবান, তেমনি সম্মানিত এক সাহাবী।


আল্লাহর রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) প্রতিদিন নিয়মিত যেতেন তার বাড়িতে। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তার পরামর্শ গ্রহণ করতেন।


রাসূলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বর্ণনায় এবং আল কুরআনেও হযরত আবু বকরের (রা) মর্যাদা সম্পর্কে বিশেষভাবে উল্লেখিত হয়েছে।


তার আত্মত্যাগ, তার ধৈর্য, সাহস, বিচক্ষণতা, দূরদর্শিতা, প্রজ্ঞা এবং হীরক সমান জ্ঞান- এসবই ইসলামের বিজয়ের জন্য কাজ করেছে বিপুলভাবে।


হযরত আবু বকর (রা)!


তার উপমা- নদী তো নয়, বিশাল সাগর।


সাগরের অধিক।


আমরা এখনো যেন শুনতে পাই সেই দূর সাগরের ডাক।


১ম অংশ


খাপ খোলা তলোয়ার।


একবারেই অন্ধকার যুগ।


পাপে আর পাপে ছেয়ে গেছে আরবের সমাজ।


মানুষের মধ্যে হানাহানি, যুদ্ধ, রক্তারক্তি লেগেই আছে।


মানুষের হেদায়েতের জন্যে আল্লাহ পাক নবীকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) পাঠিয়েছেন। তিনি মানুষকে আলোর পথে ডাকছেন। ডাকছেন মুক্তির পথে।


নবীর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ডাকে যারা সাড়া দিলেন, তাঁরা আলোর সন্ধান পেলেন। নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) সাথে তাঁরাও ইসলাম প্রচার করেন।


কিন্তু গোপনে গোপনে। চুপে চুপে।


কাফেরদের অত্যাচারের ভয়ে কেউ ইসলাম গ্রহণের কথা প্রকাশ করেন না। আসলে, তখন সেই পরিবেশও ছিল না। পবিত্র কাবা ঘরে কেউ নামাজও আদায় করতে পারতেন না।


নামাজ আদায় করতেন তাঁরা গোপনে গোপনে।


কিন্তু এভাবে আর কতদিন?


সময় পাল্লে যায়।


পাল্টে যায় কালের নির্মম ইতিহাস।


সময়টাকে পাল্টে দেন হযরত ওমর। আল্লাহর অপরিসীম রহমতে। ওমর ইসলামগ্রহণ করার পরপরই মক্কার আকাশে বাতাসে নতুন হওয়া বইতে শুরু করে।


শুরু হলো ইসলাম প্রচার ও প্রতিষ্ঠার আর একটি নতুন অধ্যায়।


এতদিন কাফেরদরে ভয়ে কেউ ইসলাম গ্রহণের কথা প্রকাশ করতে পারেননি।


কিন্তু ওমর?


ইসলাম গ্রহণের পর তিনিই সর্বপ্রথম প্রকাশ্যে ঘোষণা দিলেন, সবাইকে জানিয়ে দিলেন ইসলাম গ্রহণের কথা।


নির্ভীক ওমর! দুঃসাহসী ওমর!


তাঁর সাহস আর বীরত্বের কথা জানে না- মক্কায় তেমন কোনো লোকই নেই। ক্ষ্যাপা বারুদের মতো তাঁর তেজ।


রেগে গেলে ওমর মুহূর্তেই যে কোনো চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে পারেন। তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে বুকটান করে কেউ কথা বলার সাহস রাখে না। সবাই তাঁকে ভয় করে চলে।


ইসলাম গ্রহণের আগে ওমর সম্পর্কে এ রকম ধারণা ছিল মক্কার সকল মানুষের।


ওমরের তলোয়ারকে ভয় করে না, এমন লোক মক্কায় নেই।


সেই দুঃসাহসী ওমর ইসলাম গ্রহণ করেছেন!


ইসলাম গ্রহণের কথা প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়েছেন!


শুধু কি তাই?


তিনি সঙ্গী-সাথীদেরকে নিয়ে মক্কার পবিত্র কাবা ঘরে প্রবেশ করলেন। প্রকাশ্যে নামায আদায় করলেন।


এই প্রথম কাবাঘরে প্রকাশ্যে নামাজ আদায়ের ঘটনা ঘটলো।


কাফেররা শুনলো সবই। দেখলো সবই। দেখলো, সঙ্গী-সাথীদেরকে নিয়ে দুঃসাহসী ওমর কাবায় যাচেনছন! নামাজ আদায় কাছেন।


কাফেররা দেখলো, কিন্তু কেউ প্রতিবাদ করতে সাহস করলো না। কেউ বাধা দিতে ছুটে এলো না।


কে আসবে ওমরের সামনে?


কে আসবে তাঁর খাপ খোলা তলোয়ারের সামনে? এমন হিম্মত কার আছে?


ওমর বীরদর্পে হেঁট গেলেন ইসলামের সবচেয়ে বড় দুশমন, সবচেয়ে বড় শত্রু আবু জেহেলের বাড়িতে। জোরে জিৎকার করে বললেন:


ইসলামের দুশমন- আবু জেহেল! আমি ইসলাম গ্রহণ করেছি। আল্লাহ ও রাসূলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) প্রতি ঈমান এনেছি এবং রাসূলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কাছে প্রেরিত বিধান  ইসলামকে সত্য বলে জেনেছি এবং মেনে নিয়েছি।


ওমরের হুংকার আবু জেহেল স্তম্ভিত হয়ে গেল। কিন্তু প্রতিবাদ করতে সাহস পেল না।


ওমর মিথ্যা ও পৌত্তলিক শক্তির বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে জিহাদ ঘোষণা করলেন।


ওমরের ইসলাম গ্রহণ করার সংবাদ চারদিকে ছড়িয়ে গেল দ্রুত গতিতে।


এ খবর শুনে কাফেরদের বুক ভয়ে আর বেদনায়টন টন করে উঠলো। আর মুসলমানদের হৃদয়ে খুশির তুফান বইতে শুরু করলো। তাঁরা আরও সাহসী হয়ে উঠলেন।


ওমর তাঁর সঙ্গী-সাথীদের নিয়ে মক্কায় প্রকাশ্যে ইসলামের দাওয়াত দিতে শুরু করলেন। কাফেরদের নাকেট ডগা দিয়ে মক্কার এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত ছুটে যান ওমর তাঁর সঙ্গী-সাথীরা।


তাঁরা একত্রে কাবায় নামাজ আদায় করেন।


কাবাঘরে তাওয়াফ করেন।


কেউ বাধা দিতে এলে তাঁরা তা প্রতিহত করেন।


তাঁরা প্রতিহত করেন কাফেরদের যে কোনো আক্রমণ।


২য় অংশ


খাপ খোলা তলোয়ার।


অন্য মুসলমানরা গোপনে হিজরত করেন মদীনয়। আর ওমর হিজরত করেন প্রকাশ্যে।


মক্কা থেকে মদীনায় হিজরত করার আগে ওমর প্রথমে কাবাঘর তাওয়াফ করেন। তারপর কুরাইশদের মধ্যে গিয়ে চিৎকার করে বলেন,


কেউ যদি তার মাকে পুত্রশোকে কাঁদাতে চায়, তাহলে সে যেন এ উপত্যকার অপর প্রান্তে আমার মুখোমুখি হয়।


এই দুৎসাহসী ঘোষণা দিয়ে বীরের মতো তিনি মদীনার পথে রওয়ানা হলেন।


কাফেররা দেখলো, ওমর চলে যাচ্ছে কিন্তু তাঁকে বাধা দিতে কেউ সাহস পেল না।


ওমরের তলোয়ারের ভয়ে তারা প্রকম্পিত।


প্রাণ হারাতে কে যাবে তাঁর তলোয়ারের সামনে।


হযরত ওমর!


দুঃসাহসী ওমর!


নির্ভীক ওমর!


একমাত্র আল্লাহ ছাড়া আর কাউকেই যিনি পরোয়া করেন না।


ভয় নামক শব্দটিকে যিনি তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিতে পারেন, তিনিই হযরত ওমর।


নবীকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তিনি ভালোবাসতেন প্রাণ দিয়ে। তাঁর সে ভালোবাসার কোনো তুলনা হয় না।


নবীর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) সাথে তিনি বদর, উহুদ, খন্দকসহ সকল যুদ্ধেই অংশ নিয়েছেন এবং বীরত্বের সাথে কাফেরদের মুকাবেলায় যুদ্ধ করেছেন।


নবীকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তিনি অত্যন্ত ভালোবাসতেন। নবীর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ওফাতের সংবাদ শুনে তিনি বিশ্বাসই করতে পারেননি যে, নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আর দুনিয়াতে নেই। নবীর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) মহব্বতে তখন তিনি পাগলপ্রায়। কোষমুক্ত তলোয়ার নিয়েওমর মসজিদে নববীর সামনে গিয়ে ঘোষণা দিলেন:


যে বলবে নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ইন্তেকাল করেছেন, আমি তার মাথা দ্বিখন্ডিত করে দেব।


ইসলামের প্রথম খলিফা আবু বকর (রা)।


আর দ্বিতীয় খলিফা হলেন হযরত ওমর (রা)।


দশ বছর খিলাফতকালে তিন গোটা বাইজাইনটাইন, রোম ও পারস্য সাম্রাজ্যের পতন ঘটান।


তিনি বহু শহর এবং বহু রাজ্য জয় করেন।


অর্ধেক জাহানে তিনি ইসলামের বিজয় পতাকা ওড়াতে সক্ষম হন।


তাঁ সময়েই তিনি জেনার জন্যেদুররা মারা এবং মদপানের জন্যে আশিটি বেত্রাঘাত চালু করেন।


অর্ধেক জাহানের শাসনকর্তা হযরত ওমর।


কিন্তু ক্ষমতার মোহ তাঁকে কখনোই সত্য থেকে দূরে ঠেলে দেয়নি।


তিনি ছিলেন ন্যায়পরায়ন শাসক। তাঁর কাছে ধনী-গরিব, ঠো-বড় কোনো ভেদাভেদ ছিল না। সকলের প্রতি ছিলেন সমান দরদি।


এতবড় শাসক হয়েও ব্যক্তিগতজীবনে ছিলেন হযরত ওমর অত্যন্ত সাধারণ একজন মানুষ। তাঁর ছিল না কোনো বাড়তি চাকচিক্যছিল না কোনো জৌলুস। খুব গরিব হালে তিনি জীবন যাপন করতেন।


কিন্তু শাসক হিসেবে তিনি ছিলেন অত্যন্ত সচেতন।


তিনি নিজের চোখে মানুষের সুখ-দুঃখ দেখার জন্যে ঘুরে ঘুরে বেড়াতেন। তিনি এবং রাতের গভীরেও। তাঁর শাসনামলে মানুষ সুন্দরভাবে জীবন যাপন করতো। নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারতো।


হযরত ওমর ছিলেন সবার কাছে অত্যন্ত শ্বিাসী। তাকে বলা হতো আমীরুল মু’মিনীন।


তিনি মানুষকে অত্যন্ত ভালোবাসতেন। সবার মুখে মুখে ফিরতো হযরত ওমরের নাম। তাঁর ইনসাফ ও ন্যায়পরায়ণতায় সকলেই মুগ্ধ ছিলো।


ভালো মানুষেরা ওমরকে ভালোবাসতো প্রাণ দিয়ে। আর দুষ্ট ও ইসলামের শত্রু ওমরের নাম শুনতেই ভয়ে কেঁপে কেঁপে উঠতো।


হযরত ওমর!


ওমরের বীরত্ব ও ন্যায়পরায়ণতা ইতিহাসে উজ্জ্বল হয়ে আছে।


ইসলাম গ্রহণের আগে তিনি যেমন ছিলেন উগ্র এবং দুঃসাহসী, ঠিক ইসলাম গ্রহণের পরও তিনি ছিলেণ সত্যের পক্ষে প্রশান্ত এবং কোমল। আর মিথ্যঅ আর অন্যায়ের বিরুদ্ধে ছিলেন বরাবরই-


খাপ খোলা তলোয়ার।


ওমর ইবনে আবুদল আযীযের ন্যায়বিচার


হযরত ওমর ইবনে আবুদল আযীয় খলীফা হবার পর সমরখন্দের এক প্রতিনিধি দল এসে অভিযোগ করলো যে, সেখানকার মুসলিম বাহিনীর অধিনায়ক এলাকার একটি শহর অতর্কিতে দখল করে সেখানকার স্থানীয় অধিবাসীদের মধ্যে জোরপূর্বক মুসলমানদের বসতি গড়ে দিয়েছেন। হযরত ওমর বিন আবদুল আযীয সমরকন্দের গভর্নরকে প্রকৃত ঘটনা কি, তার তদন্ত করার নির্দেশ দিলেন। তিনি লিখলেন যে, একজন বিচারক দ্বারা তদন্ত করতে হবে। বিচারক যদি বলেন যে, সেখান হতে মুসলমানদের বেরিয়ে যাওয়া উচিত, তাহলে তৎক্ষণাত শহর খালি করে দিতে হবে।


নির্দেশ মোতাবেক একজন মুসলিম বিচারক তদন্ত করে রায় দিলেন যে, মুসলমানদের শহর ছেড়ে চলে যাওয়া উচিত। কেননা প্রথমে তাদের শহরবাসীকে সতর্ক করা উচিত ছিল যে এবং ইসলামের সমর বিধি অনুসারে সকল চুক্তি বাতিল করা উচিত ছিল, যাতে তারা যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে পারে। তাদের ওপর অতর্কিত আক্রমণ করা উচিত হয় নি।


সমরকন্দবাসী এ রায় শুনে নিশ্চিত হলো যে, ইসলামী সরকার ইনসাফ ও ন্যায়বিচারে অতুলনীয়। এ ধরনের লোকদের সাথে যুদ্ধ করা নিরর্থক এবং এদের শাসন আল্লাহর করুণা স্বরূপ। তাই তারা তাদের এলাকায় মুসলমানদের আবাসন সানন্দে মেনে নিল।


শিক্ষাঃ


সুবিচার ও ন্যায় নীতিতে অবিচল থাকার মাধ্যমে মুসলমানরা যে কোন স্থানে অমুসলিমদের সাথে ভালো সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারে। অমুসলিমদের সাথে উত্তম সম্পর্ক বজায় রাখা ইসলাম ও মুসলমানদের স্বার্থে সব সময়ই জরুরী।


রাখাল ছেলের খোদাভীতি


একবার হযরত ওমর গভীর রাতে ছদ্মবেশে মদীনার পথ ধরে হেঁটে বেড়াচ্ছিলেন এবং প্রজাদের খোঁজখবর নিচ্ছিলেন। এই সময়ে দেখতে পেলেন এক রাখাল এক পাল ছাগল নিয়ে তার সামনে দিয়ে যাচ্ছে।


তিনি রাখালকে পরীক্ষা করার মানসে বললেনঃ “এই ছাগলগুলির মধ্যে যে কোন একটি ছাগল আমার কাছে বিক্রী করে দাও।”


রাখাল বললো, “এই ছাগলগুলো আমার নয়, আমার মনিবের। আমি তার ক্রীতদাস।”


ওমর বললেন, “আমরা যে জায়গায় আছি, এখানে তোমার মনিব আমাদেরকে দেখতে পাবে না। একটা ছাগল বেঁচে দাও। আর মনিবকে বলে দিও যে, একটি ছাগল বাঘে খেয়ে ফেলেছে।”


রাখাল রাগান্বিত হয়ে চিৎকার করে বলে উঠলোঃ “আল্লাহ কি দেখতে পাচ্ছেন না?”


ওমর চুপ করে রইলেন। রাখাল তার দিকে রাগত চোখে তাকিয়ে গরগর করতে করতে ছাগল হাঁকিয়ে নিয়ে চলে গেল।


পরদিন সকালে ওমর ঐ রাখালের মনিবের কাছে গেলেন এবং তাকে মনিবের কাছ হতে কিনে নিয়ে স্বাধীন করে দিলেন। অতঃপর বললেনঃ “ওহে যুবক! কালকে তুমি আল্লাহর সম্পর্কে যে কথাটি বলেছিলে, তা আজ তোমার দুনিয়ার গোলামী চুকিয়ে দিল।


আমি আশা করি তোমার এই খোদাভীতি তোমাকে কেয়ামতের দিন দোজখের আজাব থেকেও মুক্তি দিবে।”


শিক্ষাঃ


তাকওয়া ও সততা যত তুচ্ছ ও নগন্য মানুষের মধ্যেই পাওয়া যাক, তাকে উপযুক্ত মর্যাদা দিতে হবে।


কেননা আল্লাহ বলেছেনঃ তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তিই অধিক সম্মানিত, যে তোমাদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা সৎ ও খোদাভীরু।


হযরত ওমর (রা) ও কাযী শুরাইহের ন্যায়বিচার


একবার হযরত ওমর (রা) জনৈক বেদুইনের কাছ থেকে একটি ঘোড়া কিনলেন। ঘোড়ার দাম পরিশোধ করেই তিনি ঘোড়ায় চড়লেন এবং তাকে হাঁকিয়ে নিয়ে গেলেন। কিছুদূর যেতেই ঘোড়াটি হোঁচট খেয়ে খোঁড়া হয়ে গেল।


তিনি তৎক্ষণাৎ ঘোড়াকে পিছনের দিকে ফিরিয়ে ঐ বেদুইনের কাছে নিয়ে গেলেন। হযরত ওমর ভেবেছিলেন ঘোড়াটির আগে থেকেই পায়ে কোনো খুঁত ছিল, যা সামান্য ধাক্কা খেয়ে ভেঙ্গে গেছে। তিনি ঘোড়ার মালিককে বললেন, “তোমার ঘোড়া ফেরত নাও। এর পা ভাঙ্গা।”


সে বললোঃ “আমিরুল মু’মিনীন! আমি ফেরত নিতে পারবো না। কারণ আমি যখন বিক্রী করেছি, তখন ঘোড়াটি ভাল ছিল।”


হযরত ওমর বললেনঃ “ঠিক আছে। একজন সালিশ মানা হোক। সে আমাদের বিরোধ মিটিয়ে দিবে।”


লোকটি বললোঃ শুরাইহ বিন হারিস কান্দী নামে একজন ভালো জ্ঞানী লোককে আমি চিনি। তাকেই শালিশ মানা হোক। হযরত ওমর রাজী হলেন। উভয়ে শুরাইহের খলিফাকে জিজ্ঞেস করলেনঃ “আমিরুল মু’মিনীন! আপনি কি ঘোড়াটি সুস্থ অবস্থায় কিনেছিলেন?”


হযরত ওমর বললেন, হ্যাঁ।


শুরাইহ বললেন, তাহলে হয় আপনি ঘোড়াটি মূল্য দিয়ে কিনে নিন। নচেত যে অবস্থায় কিনেছিলেন সে অবস্থায় ফেরত দিন।


এ কথা শুনে খলিফা ওমর(রা) চমৎকৃত হয়ে বললেনঃ “এটাই সঠিক বিচার বটে। তুমি সম্পূর্ণ নির্ভূল মত ও ন্যায্য রায় দিয়েছ। তুমি কুফা চলে যাও। আজ থেকে তুমি কুফার বিচারপতি।”


সেই থেকে দীর্ঘ ষাট বছর যাবত পর্যন্ত তিনি মুসলিম জাহানের বিচারপতির দায়িত্ব পালন করেন। যতদূর জানা যায়, হযরত আলীর সময়ে তিনি খলিফার বিরুদ্ধে অনুরূপ আর একটি রায় দিয়ে প্রধান বিচারপতির পদে উন্নীত হন।


তারপর উমাইয়া শাসনকালে হাজ্জাজ বিন ইউসুফের অবর্ণনীয় অত্যাচারে বিরক্ত হয়ে তিনি পদত্যাগ না করা পর্যন্ত কোনো শাসকই তাকে পদচ্যূত করার সাহস পান নি।


সততার পুরস্কার!


রাত প্রায় দুপুর গড়িয়ে চলছে। ঘুমন্ত মদীনা নগরী। এরই অলিগলি দিয়ে ধীরপদে প্রতিদিনের মত হেটে চলেছেন ছদ্মবেশী খলীফা হযরত ওমর। খোঁজ খবর নিচ্ছেন প্রজাদের।


হঠাৎ একটি কুঁড়েঘর থেকে ফিসফিস করে একটি কথোপকথন তাঁর কানে ভেসে এল। খলীফা দাঁড়িয়ে গেলেন পুরো কথোপকথন শুনতে। এক বৃদ্ধা মহিলা তার মেয়েকে বলছে, “দুধ বেঁচতে দেয়ার সময় একটু পানি মিশিয়ে দিসনা কেন? তুই তো জানিস, কি অভাব আমাদের।


ঐটুকু দুধে আর ক’টা পয়সা হবে। একটু পানি মেশালে কিছুটা স্বচ্ছলতার মুখ দেখা যেত।”


“কিন্তু তুমি খলীফার আদেশ ভুলে গেলে, আম্মী? তিনি যে বলেছেন কেউ যেন দুধের সাথে পানি না মেশায়।”


“বলেছেন, তাতে কী হয়েছে? খলীফা বা তার কোনো কর্মচারী তো আর দেখতে আসছেন না আমরা কী করছি।”


“কিন্তু আম্মী, তিনি বা তার কোনো কর্মচারী দেখুক বা না দেখুক, তার আদেশতো প্রত্যেক মুসলমানের মেনে চলা দরকার।


তা ছাড়া খলীফা যদি নাও জানেন, আল্লাহ তো জানবেন। তিনি তো সব কিছু দেখেন, শোনেন এবং জানেন।”


খলীফা নীরবে প্রস্থান করলেন। নিজের সঙ্গীকে জিজ্ঞেস করলেনঃ “শুনলে তো? এই মেয়েটাকে কী পুরস্কার দেয়া যায় তার সততার জন্য?”


“তাকে বড়সড় একটা পুরস্কার দেয়া উচিত। ধরুন, এক হাজার দিরহাম।”


“না, তা যথেষ্ট নয়। আমি তাকে সততার সর্বোচ্চ পুরস্কার দেব। আমি তাকে আপন করে নেব।”


খলীফার সঙ্গী অবাক হয়ে ভাবতে লাগলো, খলীফা কী পুরস্কার দিতে চান?”


পরদিন সকালে খলীফা মেয়েটিকে তার দরবারে ডেকে পাঠালেন। মেয়েটি ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে এসে হাজির হলো মুসলিম সাম্রাজ্যের মহাশক্তিধর শাসকের সামনে।


খলীফা তাঁর ছেলেদের ডাকলেন। তাদেরকে শোনালেন গতরাতে তার শোনা আলাপচারিতার কথা।


তারপর বললেনঃ “হে আমার ছেলেরা, আমি চাই তোমাদের কোন একজন এই মেয়েটিকে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করুক।


কেননা এর চেয়ে ভালো কোনো পাত্রী আমি তোমাদের জন্য জোগাড় করতে পারবো বলে মনে হয় না।”


একটি ছেলে পিতার প্রস্তাবে রাজী হলো। মেয়েটিও সম্মতি দিল। আর সে খলীফার সম্মানিত পুত্রবধূতে পরিণত হলো।


বর্ণিত আছে যে, পরবর্তীকালে দ্বিতীয় ওমর নামে পরিচিত ও পঞ্চম খোলাফায়ে রাশেদ নামে আখ্যায়িত মহান শাসক ওমর বিন আবদুল আযীয এই মেয়েরই দৌহিত্র ছিলেন।


শিক্ষাঃ


এই ঘটনাটি একদিকে যেমন প্রাথমিক যুগের মুসলমানদের সততার এক অত্যুজ্জ্বল দৃষ্টান্ত তুলে ধরে, অপরদিকে তেমনি মুসলিম নেতৃবৃন্দ সততার কেমন মর্যাদা দিতেন ও কদর করতেন, তাও এ ঘটনা থেকে সুস্পষ্টভাবে জানা যায়।


মনে রাখতে হবে, গুণের কদর দিতে না পারলে সমাজে সদগুণের বিকাশ ঘটা সম্ভব নয়।


হযরত ওমর কর্তৃক স্বীয় পুত্রের বিচার


একবার হযরত ওমরের নিকট একটি অভিযোগ এল যে, তার পুত্র আবু শাহমা মদ খেয়েছে। অভিযোগটা অন্যান্য লোকের কানেও এল। অনেকে ফিসফিসানি শুরু করে দিল যে, এবার দেখবো খলিফার আইনের শাসন নিজের ছেলের ক্ষেত্রে কতটা কার্যকর হবে।


কিন্তু তাদের ধারণাটা অচিরেই মাঠে মারা গেল। কেননা অন্যরা শৈথিল্য দেখাতে পারে এই আশংকায় হযরত ওমর তাঁর ছেলের মামলা আদালতে না পাঠিয়ে নিজের হাতে তুলে নিলেন।


ছেলের মদ খাওয়ার সত্যতা প্রমাণিত হলো। ইসলামী আইনে এর শাস্তি ৮০ ঘা বেত্রদন্ড। এবারও হযরত ওমর অন্যের ওপর নির্ভর করলেন না। কেননা অন্যরা দুর্বলতা দেখাতে পারে। তিনি নিজেই পুরো ৮০ ঘা বেত্রদন্ড।


এবারও হযরত ওমর অন্যের উপর নির্ভর করলেন না। কেনান অন্যরা দুর্বলতা দেখাতে পারে। তিনি নিজ হাতেই পুরো ৮০ টা বেত্রাঘাত নিজের ছেলের পিঠে লাগালেন। আবু শাহমা এই শাস্তিতে মারা গেলেন।


কিন্তু হযরত ওমর আল্লাহর শোকর আদায় করলেন যে, তিনি তাকে এমন কঠিন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ করেছেন। কোনো কোনো রেওয়ায়াতে আছে যে, ৮০টি বেত্রাঘাতের কয়েকটি বাকী থাকতেই ছেলে মারা গেলে হযরত ওমর তার কবরের ওপর বাকী বেত্রাঘাতগুলো করেন।


শিক্ষাঃ


ইসলামী আইন ও নীতিমালা প্রয়োগের ব্যাপারে কোনো আপোষের অবকাশ নেই।


আল্লাহ বলেন, “হে মুমিনগণ, তোমরা আল্লাহ সাক্ষী হিসাবে ইনসাফ কায়েম কর, এমনকি তা যদি তোমাদের নিজেদের, পিতামাতার ও ঘনিষ্টজনদের বিরুদ্ধেও যায়।


হযরত ওমরের(রা) ন্যায় বিচারের একটি উদাহরণ


একবার কিছু সুগন্ধী দ্রব্য বাহরাইন থেকে হযরত ওমরের নিকট পাঠানো হলো।


তিনি সমবেত জনতাকে লক্ষ্য করে বললেন, “তোমাদের মধ্যে এমন কেউ আছে কি, যে এই সুগন্ধী দ্রব্যটিকে মেপে সমান ভাগ করে মুসলমানদের মধ্যে বন্টন করতে পারে?”


তাঁর স্ত্রী হযরত আতেকা বললেন, “আমিরুল মু’মিনীন, আমি পারবো।”


হযরত ওমর বললেন, “আতেকা ছাড়া আর কেউ আছে কি?”


হযরত আতেকা বললেন, “আমিরুল মু’মিনীন, আমি মেপে দিলে অসুবিধা কী?”


হযরত ওমর বললেন, “আমার আশংকা হয় যে, মাপার সময় তুমি জিনিসটা হাত দিয়ে ধরবে এবং তোমার হাত সুবাসিত হয়ে যাবে। অতঃপর সেই সুবাসিত হাত তুমি মুখে মেখে নেবে এবং সুগন্ধী উপভোগ করবে। অন্যদের চাইতে এতটুকু বাড়তি সুবিধা তুমি পেয়ে যাও, তা আমি পছন্দ করি না।”


শিক্ষাঃ


একজন সাধারণ মুসলমানের জন্য স্বীয় স্ত্রী বা অধীনস্তদের ওপর এত কঠোরতা আরোপ না করলেও চলতো।


কিন্তু খলীফা বা যে কোনো স্তরের নেতৃবৃন্দের পক্ষে এরূপ কঠোর ও সূক্ষ্ম সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরী।


কারণ নেতামাত্রই আদর্শ ও অনুকরণীয় ব্যক্তি।


তার পক্ষে নিজেকে এবং নিজের ঘনিষ্ঠজনদেরকে বিন্দুমাত্রও ছাড় দেয়ার অবকাশ নেই।


হযরত ওমর(রা) ও গভর্নর হরমুযান


পারস্যের নাহাওয়ান্দ্র প্রদেশের গভর্নর হরমুযান ইসলামের এক কট্টর দুশমন ছিল। সে মুসলমানদের সাথে পারস্যের যুদ্ধ বাধানোর প্রধান হোতা ছিল। সে নিজেও খুবই শৌর্য বীর্যের সাথে যুদ্ধ করেছিল। অবশেষে হরমুযান মুসলমানদের হাতে ধরা পড়ে ও কারাবন্দী হয়। কারাবন্দী হবার পর সে ভেবেছিল এবার আর তার রেহাই নেই। মুসলমানরা হয় তাকে দাস হিসেবে বিক্রি করে দিবে নচেৎ মৃত্যুদন্ড দিবে। কারণ তার অতীত কার্যকলাপ দ্বারা সে মুসলমানদের সাথে নিজের সম্পর্ক খুবই খারাপ করে ফেলেছিল। কিন্তু তাকে এই দুই শাস্তির কোনোটাই দেওয়া হলো না। তাকে কিছু করের বিনিময়ে মুক্তি দেয়া হলো। হরমুযান নিজের রাজধানীতে ফিরে এল, তৎক্ষণাত আরো দ্বিগুণ শক্তি নিয়ে বিদ্রোহী তৎপরতা শুরু করলো এবং এক বিরাট সেনাবাহিনী নিয়ে মুসলমানদের সাথে যুদ্ধ করতে ফিরে এলো। এবারও হরমুযান ধরা পড়ে বন্দী হলো। হরমুযানকে পাকড়াও করে যখন হযরত ওমরের(রা) কাছে নিয়ে আসা হলো তখন হযরত ওমর তাঁর উপদেষ্টাদের সাথে পরামর্শ করেছিলেন। বন্দী এবার তার মৃত্যুদন্ড সম্পর্কে প্রায় নিশ্চিত ছিল। প্রতি মুহুর্তে সে তাই মৃত্যুর আশংকা করেছিল।


সহসা হযরত ওমর জিজ্ঞেস করলেনঃ তুমিই নাহাওয়ান্দ্রের বিদ্রোহী গভর্নর?


হরমুযানঃ জ্বি, আমিই।


হযরত ওমরঃ তুমি কি সেই ব্যক্তি যে বার বার মুসলমানদের সাথে চুক্তি ভঙ্গ করে?


হরমুযানঃ জ্বী, আমিই।


হযরত ওমরঃ এ ধরনের শাস্তি যে মৃত্যুদন্ড তা তুমি জান?


হরমুযানঃ জ্বী, জানি।


হযরত ওমরঃ বেশ, তাহলে তুমি এই শাস্তি এখনি নিতে প্রস্তুত?


হরমুযানঃ আমি প্রস্তুত। তবে মৃত্যুর পূর্বে আপনার নিকট আমার্ একটিমাত্র আবেদন আছে।


হযরত ওমরঃ সেটি কী?


হরমুযানঃ আমি খুব পিপাসা বোধ করছি। আমি এক গ্লাস পানি চাইতে পারি?


হযরত ওমরঃ অবশ্যই।


এই সময় হযরত ওমরের নির্দেশে তাকে এক গ্লাস পানি দেয়া হলো।


হরমুযানঃ আমিরুল মু’মিনীন, আমি আশংকা করছি যে, আমি পানি খাওয়ার সময়েই আমার মস্তক ছিন্ন করা হতে পারে।


হযরত ওমরঃ কখনো নয়। তোমার এই পানি খাওয়া শেষ হবার আগে কেউ তোমার চুলও স্পর্শ করবে না।


হরমুযানঃ (একটু থেমে) আমিরুল মু’মিনীন, আপনি আমাকে কথা দিয়েছেন যে আমি এই পানি খাওয়া শেষ না করা পর্যন্ত আপনারা আমার চুলও স্পর্শ করবেন না। আমি পানি পান করবো না। (এই বলেই সে পানি ঢেলে ফেলে দিল)। এখন আপনি আমাকে হত্যা করতে পারেন না।


হযরত ওমরঃ (মুচকি হেসে) ওহে গভর্নর, এটা তোমার চালাকী। যাহোক, ওমর যখন কথা দিয়েছে, তখন সে তার কথা রাখবেই। যাও, তুমি মুক্ত।


এর কিছুকাল পরে একদিন হরমুযান একদল সঙ্গী পরিবেষ্টিত হয়ে আবার মদীনায় এল এবং হযরত ওমরের সাথে সাক্ষাত করলো। সে বললো, “আমিরুল মু’মিনীন, এবার আমি নতুন জীবনের সন্ধানে এসেছি। আমাদের সবাইকে ইসলামে দীক্ষিত করুন।”


হযরত ওমরের(রা) শাসনে প্রজাদের সম অধিকার


মিশর বিজয়ী সেনাপতি আমর ইবনুল আস তখন মিশরের গভর্নর। তাঁর শাসনে মিশরের জনগণ বেশ শান্তিতেই কাটাচ্ছিল। কিন্তু তাঁর একটা বেয়াড়া ছেলে তাঁর ন্যায়পরায়নার সুনাম প্রায় নষ্ট করতে উদ্যত হয়েছিল।


সে যখনই পথে বেরুত, সবাইকে নিজের চালচলন দ্বারা বুঝিয়ে দিত যে, সে কোনো সাধারণ মানুষ নয়, বরং গভর্নরের ছেলে।


একদিন সে জনৈক মিশরীয় খৃস্টানের ছেলেকে প্রহার করলো। দরিদ্র মিশরীয় গভর্নরের কাছে তার ছেলের বিরুদ্ধে অভিযোগ করার সাহস পেল না। তাই নীরবে হজম করলো।


কয়েকদিন পর তার জনৈক প্রতিবেশি মদীনা হতে ফিরে এসে জানালো যে, খলিফা ওমর অত্যন্ত ন্যায়পরায়ণ শাসক। তিনি জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সকলের সমান অধিকার নিশ্চিত করেন এবং কেউ কারো ওপর যুলুম করেছে জানলে কঠোর শাস্তি দেন।


এ কথা শুনে ঐ মিশরীয় খৃস্টান একটি উটের পিঠে চড়ে দীর্ঘ সতেরো দিন চলার পর মদীনায় খলিফার কাছে পৌছলো এবং গভর্নরের ছেলের বিপক্ষে মোকদ্দমা দায়ের করলো। হযরত ওমর তৎক্ষণাত হযরত আমর ইবনুল আস এবং তার ছেলেকে মদীনায় ডেকে আনলেন। অতঃপর বিচার বসলো।


সাক্ষ্য প্রমাণ দ্বারা হযরত আমর ইবনুল আসের(রা) ছেলে দোষী প্রমাণিত হলো।


খলিফা ওমর(রা) অভিযোগকারীর ছেলেকে দেখিয়ে বললেন, সে তোমাকে যেভাবে যে কয়বার প্রহার করেছে তুমিও সেই কয়বার তদ্রুপ প্রহার কর। ছেলেটি যথাযথভাবে প্রতিশোধ নিল।


তারপর খলিফা বললেন, “প্রজারা শাসকের দাস নয়। শাসকরা প্রজাদের সেবক।


প্রজারা ঠিক তেমনি স্বাধীন যেমন তাদের মায়ের পেট থেকে ভূমিষ্ঠ হবার সময় স্বাধীন


উমর (রা) জমির মালিক হওয়ার পর


মদীনায় হিজরতের পর উমর (রা) দরিদ্রের জীবন যাপন করতেন।


খাইবার যুদ্ধের পর তাঁর ভাগে পড়লো উৎকৃষ্ট এক খণ্ড জমি, যা উমরের জন্যে নিয়ে


এলো সচ্ছল জীবনের এক সম্ভাবনা।


জমির মালিকানা পাওয়ার পর উমর (রা) মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর কাছে হাজির হলেন।


বললেন, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ, খাইবারে আমি খানিকটা জমি পেয়েছি।


এত মূল্যবান সম্পত্তি আমি কোনদিন পাইনি। এ সম্পর্কে আপনার নির্দেশ কি?’


আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) উমরের মনোভব বুঝলেন।


তঁকে বললেন, “যদি তোমার মন চায়, তাহলে আসল জমি নিজের অধিকারে রেখে জমির ফসল দান করে দাও।”


তাই করলেন উমর (রা)। গরীর-দুঃখী ও অভাবী আত্মীয়-স্বজনদের সাহায্য, গোলামদের আজাদ কর ও


জনকল্যাণমূলক কাজের জন্যে তিনি তার প্রাপ্ত গোটা সম্পত্তি ওয়াকফ করে দিলেন।


দারিদ্র স্ছলতার প্রতি কোনো লোভ উমরের (রা) মধ্যে সৃষ্টিপ করতে পারেনি।


ইবনে আবজা যে কারণে গভর্নর হলেন


উমর (রা)-এর ফিলাফত-কাল। মক্কায় গভর্নর নিযুক্ত করেছেন তিনি নাফে ইবনুল হারিসকে।


কোন এক প্রয়োজনে খলিফা উমর (রা) এসেছিলেন আরবেরই ‘উসফান’ নামক স্থানে। খলিফা সেখানে মক্কার গভর্নর নাফেকেও ডেকে পাঠিয়েছিলেন।


নাফের সাথে যখন উসফানে উমর (রা)-এর সাক্ষাৎ হলো, তখন তিনি নাফেকে (রা) জিজ্ঞাসা করলেন, ‘মক্কায় তুমি কাকে তোমার স্থলাভিষিক্ত করে এসেছ?’ নাফে বললেন, ‘আজাদকৃত গোলাম ইবনে আবজাকে আমার স্থলাভিষিক্ত করে এসেছি।’


উমর (রা) ইবনে আবজাকে পুরোপুরি জানতেন না। বললেন, “সেকি! একজন আজাদকৃত গোলামকে মক্কাবাসীদের উপর নিজের স্থলাভিষিক্ত করে দিয়ে এলে”?


নাফে বলল, “তিনি কুরআনে অভিজ্ঞ, শরীয়তে সুপণ্ডিত এবং সুবিচারক।”


উমর (রা) স্বগতোক্তির মত বললেন, “হবেই তো! রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলে গেছেন, আল্লাহ তায়ালা এই কিতাব দ্বারা অনেককে ওপরে তুলবেন, অনেককে নীচে নামাবেন।”


উমর (রা) লোকদের সামনে সা’দকে দোররা কষলেন


মদীনা শরীফ। ইসলামী সাম্রাজ্যের রাজধানী। খলিফা উমর (রা) লোকদের মধ্যে বায়তুল মালের কিছু অর্থ বণ্টন করছেন।স্বাভাবিকভাবেই বিরাট ভিড় জমে গেছে। এ সময় সেখানে এলেন সা’দ ইবনে আবী ওয়াক্কাস। তিনি প্রভাবশালী ও অভিজাত মায়ের সন্তান।


ভিড় দেখার পর অন্যান্যদের মত তাঁর ধৈর্য ধরার দরকার ছিল, কিন্তু তা তিনি করলেন না। তিনি ভিড় ঠেলে, দু’হাত দিয়ে লোকদের সামনে থেকে সরিয়ে উমরের কাছে গিয়ে হাজির হলেন। উমর (রা) ব্যাপারটা আগেই লক্ষ্য করেছিলেন।


সুতরাং সা’দ ইবনে আবী ওয়াক্কাস তাঁর সামনে হাজির হতেই উমর (রা) তাঁর হাতের দোররা কষলেন তাঁর পিঠে। উপস্থিত সবাই দেখল খলিফা একটা দোররা মেরেছেন সা’দ ইবনে আবী ওয়াক্কাসকে।


দোররা মারার পর হযরত উমর (রা) সা’দ ইবনে আবী ওয়াক্কাসকে লক্ষ্য করে বললেন, “সবার এবং সবকিছুর উপরে যে আল্লাহর আইন, তা তোমার মনে নেই।


আল্লাহর আইনের মুকাবিলায় তোমার কানাকড়িও যে মূল্য নেই, এটা তোমাকে বুঝিয়ে দেয়া প্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছিল।


উমর (রা) মনিব ও চাকরকে একসাথে খাওয়ালেন


মক্কা শরীফের একটি ঘটনা। উমর (রা) তখন মক্কায়। তিনি পথ দিয়ে কোথাও যাচ্ছিলেন। হঠাৎ তাঁর চোখ গেল পাশেরই এক বাড়ীতে। বাড়ীর মালিকরা বসে খাচ্ছে আর চাকর-বাকররা পাশে দাঁড়িয়ে আছে। ক্রুদ্ধ হলেন উমর (রা)। তিনি থমকে দাঁড়ালেন এবং গিয়ে উঠলেন সেই বাড়ীতে।


বললেন, “ব্যাপার কি! নিজেদের চাকর-বাকরদের সাথে এই বৈষম্যমূলক ব্যবহার করছ কেন?” বাড়ীর মালিকরা লজ্জিত ও অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল।


চাকর-বাকরদের সাথে এই ব্যবহার জাহেলিয়াতের যুগে চলে আসা বহু বছরের অভ্যাস।


এই অভ্যেস এখনও নির্মূল হয়নি!


উমর (রা) চাকর-বাকরদেরকে ডেকে মনিবদের সাথে খানয় বসিয়ে দিলেন।


তারপর আবার ফিরে চললেন আপন গন্তব্য।


আবু বকর উমরকে চাইলেন উসামার কাছে


মুসলিম বাহিনী যাত্রা করেছে মু’তা অভিযানে। বাহিনীর সেনাপতি উসামা বিন যায়েদ। উসামা ঘোড়ায় সওয়ার। বাহিনীকে বিদায় দেয়ার জন্য খলিফা আবু বকর উসামার ঘোড়ার পাশাপাশি হেঁটে চলেচেন। অস্বস্তিবোধ করছেন উসামা। মহামান্য খলিফাতুল রাসূল (রা) হাঁটবেন আর উসামা তাঁরই সামনে ঘোড়ায় বসে থাকবে।


উসামা খলিফা আবু বকর (রা)-কে বললেন, হে খলিফাতুর রাসূল, আপনি সাওয়ারিতে উঠুন, নয়তো আমি ঘোড়া থেকে নেমে পড়ব। সংগে সংগে আবু বকর (রা) বললেন, ‘আল্লাহর কসম, তুমি নিচে নেমনা।’


এই কথা আবু বকর (রা) তিন বার উচ্চারণ করলেন।


অথচ এই উসামা আযাদ করা দাস যায়েদের সন্তান। উসামার এই বাহিনীতে উমর ছিলেন এক সাধারণ সৈনিক। উসামার বাহিনীর সাথে উমারও যাচ্ছেন মু’তা অভিযনে। শেষ মুহূর্তে খলিফা আবু বকরের মনে পড়ল, উমরের মদীনা থেকে অনুপস্থিত থাকা উচিত নয়। তাঁকে খলিফার দরকার হবে। কিন্তু তিনি তো উমর (রা)-কে মদনিায় থাকার নির্দেশ দিতে পারেন না। সেনাপতি উসামা তাঁর একজন সৈনিকিকে নিয়ে যাবেন না রেখে যাবেন, সে সিদ্ধান্ত সম্পূর্ণ উসামার।


খলিফা আবু বকর উসামাকে নির্দেশ নয় অনুরোধ করলেন, ‘যদি আপনি ভাল মনে করেন, তবে অনুগ্রহপূর্বক উমরকে আমার সাহায্যের জন্যে রেখে যান।’ ইসলামের এই সাম্য ও গণতন্ত্রের কোন তুলনা নেই পৃথিবীতে।


উমর (রা) নিজের অহংকারকে শাস্তি দিলেন


উমর ইবনুল খাত্তাব (রা) তখন আমীরুল মুমিনীন, অর্ধ পৃথিবীর শাসক।


ইনসাফের ব্যাপারে আপোষহীন উমারের (রা) শাসনদণ্ডকে ভয় না করেন এমন মানুষ নেই।


একদিন দেখা গেল সেই উমর ইবনুল খাত্তাব ভারি একটি পানির মশক ঘাড়ে নিয়ে হাঁটছেন।


বিস্মিত, বিক্ষুদ্ধ তাঁর পুত্র তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “কেন আপনি এরূপ করছেণ?”


উমর (রা) বললেন, “আমার মন অহংকার ও আত্মগরিমায়


লিপ্ত হয়েছিল, তাই ওকে আমি শাষেস্তা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।”


উমর (রা) ন্যায়দণ্ডের রক্ষায় মানুষের ব্যাপারে যেমন


কঠোর ছিলেন, তেমনি কঠোর ছিলেন নিজের ব্যাপারেও।


আল্লাহর রাহে খরচের আকাংখ্যা


অষ্টম হিজরী সাল।


সাইফুল বাহার যুদ্ধে যোগদান করেছে মুসলিমানদের একটি ছোট্ট বাহিনী।


এই তিনশ, সদস্যের বাহিনীর মধ্যে আবু বকর (রা) ও উমর (রা) ছিলেন।


আর ছিলেন মদীনার খাজরাজ সর্দার সা‘আদ বিন উবাদাহর ছেলে কায়েস (রা)।


এই মুসলিম বাহিনীর অধিনায়ক ছিলেন আবু উবায়দাহ ইবনুল যাররাহ (রা)।


অভিযানকালে মুসলিম বাহিনীর রসদ ফুরিয়ে গেলে ভয়ানক সংকটে পড়ল তারা।


এই অবস্থা দেখে কায়েস উট ধার করে এনে সবার জন্যে জবাই করতেন।


এভাবে তিনি তিন দিনে ৯টি উট ধার করে জবাই করার পর আবু বকর ও উমর চিন্তিত হয়ে পড়লেন এবং অধিনায়ক আবু উবায়াদাহ ইবনুল যাররাহকে গিয়ে বললেন, ‘কায়েস এভাবে যদি প্রতিদিনউট ধার করে এন জবাই করতে থাকে, তাহলে তার পিতার সব সম্পদ সে এখানেই শেষ করে দেবে। আপনি তাকে উট জবাই থেকে বারণ করুন।’


আবু উবায়দা (রা) কায়েসকে সে মুতাবিক নির্দেশ দিলেন।


যুদ্ধ থেকে মদীনায় ফেরার পর কায়েস (রা) পিতার কাছে মুসলিম বাহিনীর রসদ সংকট ও দুঃখ-দুর্দশার কথা জানালেন।


পিতা তাকে বলল, তুমি উট যোগাড় করে সকলের জন্যে জবাই করতে পারতে।


কায়েস (রা) বললেন, পর পর তিন দিন আমি তাই করেছি।


কিন্তু আবু বকর (রা) ও উমর (রা) এই কথা বলায় অধিনায়ক আবু উবায়দা (রা) আমাকে উট জবাই করতে বারণ করেন।


ক্ষোভ ও আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়লেন সা‘আদ (রা) ইবনে উবাদাহ।


তিনি ছুটলেন মহানবীর কাছে। মহানবী (সা) তখন বসেছিলেন।


সা‘আদ (রা) তাঁর পেছনে এসে দাঁড়ালেন এবং অভিমান-ক্ষুব্ধ ও আবেগ-জড়িত কণ্ঠে মহানবী (সা)-কে বললেন, “ইবনে আবু কুহাফাহ এবং ইবনে খাত্তাব-এর পক্ষ থেকে কেউ জবাব দিক যে, তারা আমার পুত্রকে কেন বখিল বানাতে চান


দুনিয়াটা আপনাদের মত বুজুর্গের কারণে টিকে আছে


তখন উমর ফারুক (রা)-এর খিলাফতকাল।


উবাদাহ বিন সামিত তখন ফিলিস্তিনীদের কাজী।


আর মুয়াবিয়া (রা) সেই ফিলিস্তিনের গভর্নর।


উবাদাহ (রা) অন্যায়-অসংগতি তা যত ছোটই হোক, তার কাছে নতি শিকার করতো না।


এই উবাদাহ (রা)-এর সাথে একদিন কথা কাটাকাটি হয়ে গের মুয়াবিয়ার (রা)।


গভর্নর মুয়াবিয়া তাকে কিছু কঠোর কথা শোনালেন।


হযরত উবাদা (রা) তা সহ্য করলেন না। ফিলিস্তিন ছেড়ে চলে এলেন মদীনায়।


আসার সময় মুয়াবিয়া (রা)-কে বললেন, ‘ভবিষ্যতে আপনি যেখানে থাকবেন, আমি সেখানে থাকবো না।’


মদীনায় ফিরে এলে খলিফা উমর (রা) তাঁকে এর কারণ জিজ্ঞাসা করলেন।


বললেন সব কথা উবাদাহ (রা)।


সব শোনার পর খলিফা উমর (রা) বললেন, “আমি আপনাকে কোনক্রমেই সেখান থেকে সরিয়ে আনবো না। দুনিয়াটা আপনাদের মত বুজুর্গের কারণেই টিকে আছে।


যেখানে আপনাদের মত লোক থাকবে না, আল্লাহ সেই জমিনকে খারাপ ও ধ্বংস করে দেবেন।


আপনি আপনার স্থানে ফিরে যান।


আমি আপনাকের মুয়াবিয়ার (রা) অধীনতা থেকে পৃথক করে দিলাম।”


খলিফা উমর (রা) অনুরূপভাবে গভর্নর মুয়াবিয়াকেও লিখে পাঠালেন।


হযরত উমর (রা)-এর কঠোর সিদ্ধান্ত


হযরত আবু বকর (রা)-এর খিলাফতকাল।


দুই সাহাবী আকরা বিন হারিস এবং আইনিয়া বিন হাসান আবু বকরের দরবারে হাজির হলেন।


মহানবী (সা) তালিফে কুলুব হিসেবে যাদের সাহায্য করতেন, আকরা তাদের একজন।


তারা খলিফা আবু বকরের কাছে ‘জায়গীর‘-এর আবেদন জানালেন।


আবু বকরের দরবারে তখন উমর ফারুক (রা) হাজির ছিলেন।


তিনি আকরা (রা)-কে উদ্দেশ্য করে বললেন, “রাসূলুল্লাহ (সা) তোমাকে তালিফে কুলূব করতেন।


এখন তোমার পরিশ্রম কর উচিত।” আবু বকর (রা) রাসূল (সা)-এর আমলের সকল দান ও উপঢৌকন বহাল রাখেন এবং আকরা ও আইনিয়া হাসানের আবেদন অনুসারে তাদের জমি বরাদ্দের লিখিত নির্দেশ দিলেন।


এর অনেক পরের ঘটনা।


তখন উমর ফারুক (রা)-এর শাসনকাল।


আকরা (রা) এবং আইনিয়া হাসান এলেন তাঁর কাছে এবং আবেদন করলেন আবু বকর (রা) কর্তৃক নির্দেশ বহাল রাখার জন্যে।


উমর (রা) তাদের আবেদন প্রত্যাখ্যান করলেন এবং বললেন, “আল্লাহ ইসলামের বিজয় দিয়েছেন এবং তোমাদের থেকে মুখাপেক্ষীহীন করেছেন।


এখন তোমরা (জায়গীর ও উপঢৌকন ছাড়া) ইসলামের উপর মজবুতভাবে দাঁড়িয়ে যাও।


নচেৎ আমাদের ও তোমাদের মধ্যে তরবাবিই ফায়সালা করবে।”


উপর (রা)-এর এই সিদ্ধান্ত কঠোর হলেও তার মধ্যে কোন বিরূপ প্রতিক্রিয়াই হলো না।


আকরা (রা) হাসিমুখে ও আন্তরিকতার সাথে এই সিদ্ধান্ত মেনে নিলেন।


অতঃপর জিহাদের ময়দান হলো আকরা (রা)-এর স্থান।


যদ্ধরত অবস্থায়ই তিনি শাহাদাত তিনি শাহাদাত বরণ করেন।


ফাতহুম মুবিনে’র প্রথম বন্দী


‘ফাতহুম মুবিন’ বা মক্কা বিজয়ের মহামুহূর্হটি সমাগত। দশ হাজার মুসলিম সৈন্যে বাহিনী সেদিন গভীর রাতে মক্কার উপকণ্ঠ মাররুজ-জাহরান উপত্যকায় গিয়ে পৌঁছল এবং সেখানেই রাত যাপনের সিদ্ধান্ত নিলো।


মক্কার কুরাইশ নেতা আবু সুফিয়ান ও আরও কয়েকজন রাতে মক্কার উপকণ্ঠে পৌঁছে গেছে। মাররুজ্-জাহরান উপত্যকায় হাজার আলোর সারি দেখে স্তম্ভিত হলো আবু সুফিয়ান। রহস্য উদ্ধারের জন্যে আবু সুফিয়ানকে অতি সন্তর্পণে এগুলো ঐ উপত্যকার দিকে।


হঠাৎ আবু সুফিয়ান বন্দী হয়ে গেলো হযরত উমর (রা)-এর হাতে। হযরত উমর (রা) আরও কয়েকজনকে সাথে নিয়ে পাহারা দিচ্ছিলেন মুসলিম বাহিনীর অগ্রবর্তী দিকটা।


হযরত উমর (রা) আবু সুফিয়ানকে মহানবীর সামনে হাজির করে বললেন, সত্যের শত্রুদের সমূলে উৎপাটিত করার শুভমুহূর্ত সমাগত। আবু সুফিয়ান বন্দী।


প্রতিশোধ গ্রহণ ও প্রতিফল দানের সময় উপস্থিত। মহানবী (সা) এ প্রসঙ্গে না গিয়ে আবু সুফিয়ানকে সন্বোধন করে বললেন, আবু সুফিয়ান, এখনও তুমি সেই করুণা-নিধান ‘ওয়াহদাহু লা-শারিকালাহু’ কে চিনতে পারোনি? আবু সুফিয়ানের বিমর্ষভাবে আমতা করে বললো, ‘তা, এখন পারছি বৈ কি।


আমাদের ঠাকুর কেউ থাকলে আমাদের পানে তাকাতো।’ আবু সুফিয়ানের উত্তরে উৎসাহিত হয়ে মহানবী (সা) আবার জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আচ্ছা আবু সুফিয়ান, আমি যে আল্লাহর প্রেরিত সত্য নবী, এ ব্যাপারে এখনও কি তোমার সন্দেহ আছে?’


আবু সুফিয়ান বললো, ‘এখনও কিছু কিছু সন্দেহ আছে?’ মহানবী (সা) বন্দী আবু সুফিয়ানের কথায় বিন্দুমাত্রও ক্রুদ্ধ হলেন না এবং তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও গ্রহণ কররেন না।


শুধুমাত্র মহানবী (সা) আবু সুফিয়ান যখন ফিরে যাবার জন্যে উত্যত হলেন, তখন তাকে আদেশ করলেন সকাল পর্যন্ত থেকে যেতে।


মহানবী (সা) রোধ হয় চেয়েছিলেন আবু সুফিয়ান ফিরে গিয়ে গোঁট পাকাবার কোন সুযোগ না পাক।


 হযরত খাব্বাব (রা) এর ত্যাগ ও কুরবানী


হযরত ওমর(রা) ইসলাম গ্রহণের পূর্বে নগ্ন তরবারী হাতে নিয়ে যেদিন রাসূল(সা) কে হত্যা করতে রওয়ানা হয়েছিলেন, সেইদিন পথিমধ্যে নিজের বোন ও ভগ্নিপতির ইসলাম গ্রহণের খবর পেয়ে সাময়িকভাবে গন্তব্য স্থান পরিবর্তন করেন এবং প্রথমে বোন ভগ্নিপতিকে ইসলাম গ্রহণের শাস্তি দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন।


বোনের বাড়ীতে গিয়ে দেখতে পান তারা কুরআন পড়ছে। আর যে ব্যক্তি কুরআন পড়াচ্ছিলেন তিনি ছিলেন খাব্বাব ইবনে আরত(রা)। হযরত ওমর বাড়িতে প্রবেশ করা মাত্রই খাব্বাব প্রাণভয়ে আত্মগোপন করেন। কেননা বোন ভগ্নিপতি রক্তের টানে রক্ষা পেলেও সেদিন খাব্বারের বাঁচার কোনো আশা ছিল না ওমরের নগ্ন তরবারী হতে।


সেদিন যা হবার তা হলো। প্রথম সাক্ষাতে বোন ভগ্নিপতি কিছু মার খেলেও কুরআনের আয়াত ক’টি পড়ে তাঁর আমূল পরিবর্তন ঘটে এবং তিনি রাসূলের(সা) কাছে গিয়ে ইসলাম গ্রহণ করেন। খাব্বাবের সাথে হযরত ওমরের হয়েছিল সেইদিন প্রথম সাক্ষাত। তারপর দরিদ্র খাব্বাবের উপর মক্কার কোরেশদের আরো অনেক নির্যাতন হয়েছে। হযরত ওমর শুনেছেন, কিন্তু প্রতিকার করতে পারেন নি।


কিন্তু আজ সম্পূর্ণ ভিন্ন পরিবেশে হযরত ওমরের সামনে বসে আছেন মহান ত্যাগী সাহাবী খাব্বাব। আজ ইসলাম বিজয়ী আসনে অধিষ্ঠিত। হযরত ওমর আজ মুসলিম জাহানের দ্বিতীয় খলিফা। তাওহীদ ও রিসালাতের সাথে সংঘর্ষে কুফর ও শিরক চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেছে। জাহেলিয়াতের অন্ধকার দূর হয়ে ইসলামের আলোকে চারদিক উদ্ভাসিত।


কিন্তু হযরত ওমরের(রা) প্রবল ইচ্ছা, খাব্বাবের সেই নির্যাতনের কাহিনীগুলো শুনবেন। তাই জিজ্ঞাসা করলেন, “ইসলাম গ্রহণের পর আপনার উপর কি ধরনের নির্যাতন হয়েছে, একটু বলবেন?”


হযরত ওমরের প্রশ্ন হযরত খাব্বাবকে আবার দূর অতীতে টেনে নিয়ে গেল এবং মক্কার ১৩ বছরের সেই রক্তক্ষরা দিনগুলিকে তার চোখের সামনে হাজির করলো। সে নির্যাতনে ঈমান ও একীনে উজ্জীবিত মর্দে মুমিনরা ছাড়া আর কেউ তেরো বছর তো দূরের কথা, তেরো দিনও বরদাশত করতে পারতো না। হযরত খাব্বাব কোন্ কাহিনী দিয়ে শুরু করবেন এবং কোনটা বাদ্ দিয়ে কোনটা বলবেন।


তাই ভেবে ভেবে কয়েক মুহুর্ত নীরবে কাটিয়ে দিলেন। শেষে বলতে চেয়েও বলতে পারলেন না। অবশেষে প্রশ্নের জবাব না দিয়ে নিজের জামা খুলে কোমরের একটি অংশ আমিরুল মোমেনীনকে দেখালেন। জায়গাটা ছিল জখমের চিহ্নে পরিপূর্ণ। আমীরুল মুমিনীন দেখামাত্র চিৎকার করে বলে উঠলেনঃ


“আল্লাহু আকবার! এই নাকি আপনার কোমর। আমি তো আজ পর্যন্ত কোন মানুষের এমন কোমর দেখি নি।”


খাব্বাব বললেন, “জি, আমিরুল মোমেনীন, কতবার যে আমাকে লোহার বর্মসহ তপ্ত মরুভূমিতে টেনে হিচড়ে বেড়ানো হয়েছে এবং কতবার যে আমার কোমরের চর্বিতে ওদের আগুন নিভেছে, তা আমি স্মরণ করতে পারি না। তারপর আল্লাহর শোকর যে, একদিন আমরা সমস্ত নির্যাতন থেকে মুক্তি পেলাম।”


সহসা হযরত খাব্বাব কান্না শুরু করে দিলেন।


হযরত ওমর বললেন, “ খাব্বাব, আজ কেন কাঁদছেন?”


হযরত খাব্বাব চোখের পানি ফেলতে ফেলতে জবাব দিলেন, “আমি কাঁদছি এজন্য যে, জেহাদের পর জেহাদ করে বিজয় অর্জন করার পর আল্লাহ আমাদের জন্য সুখ সমৃদ্ধি ও ধন দৌলতের দ্বার খুলে দিয়েছেন। আমাদের মাথার উপর সম্মান ও মর্যাদার পতাকা উড়ছে। আমার আশংকা হয় যে আমাদের ক্ষুদ্র ও সৎ কাজগুলির প্রতিদান দুনিয়াতেই দিয়ে দেয়া হচ্ছে কি না এবং আখেরাতে আমাদের খালি হাতে উঠতে হবে কি না।”


এই নিঃস্বার্থ ত্যাগী পুরুষ ইন্তিকালের সময় ওসিয়ত করেন, “ আমাকে তোমরা লোকালয়ে নয়, কুফার জংগলে কবর দিও।


জংগল আমাকে ডাকছে।”


তাঁর ইন্তিকালের পর একদিন হযরত আলী(রা) তাঁর কবরের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বললেন, “আল্লাহ খাব্বাবের ওপর রহমত করুন।


তিনি স্বেচ্ছায় ও সানন্দে ইসলাম গ্রহণ করেন, সানন্দে হিজরত করেন, জেহাদে জীবন কাটান এবং মুসিবতের পর মুসিবত বরদাশত করেন। অথচ নিজের প্রয়োজনের চেয়ে এক চুলও বেশি পরিমাণ সম্পদ অর্জন করেন নি।


জাবালার ঔদ্ধত্য ও হযরত ওমর (রা)


একবার হযরত ওমর(রা) হজ্জ করতে মক্কায় এলেন।


তিনি কা’বার চারপাশে তওয়াফ করছিলেন। তাঁর সাথে সাথে একই কাতারে তওয়াফ করছিলেন সদ্য ইসলাম গ্রহণকারী প্রতিবেশী এক রাজা জাবালা ইবনে আইহাম। জাবালা কা’বার চারপাশ প্রদক্ষিণ করার সময় সহসা আর এক তওয়াফকারী জনৈক দরিদ্র আরব বেদুইনের পায়ের তলায় চাপা পড়ে জাবালার বহু মূল্যবান ইহরামের চাদরের এক কোণা। চাদরটি রাজার কাঁধের ওপর থেকে টান লেগে নীচে পড়ে যায়।


ক্রোধে অগ্নিশর্মা হয়ে ওঠেন জাবালা। লোকটির কোনো ওজর আপত্তি না শুনে জাবালা তার গালে প্রবল জোরে একটি চড় বসিয়ে দেন।


লোকটি তৎক্ষণাত খলীফার নিকট গিয়ে নালিশ করে এবং এই অন্যায়ের বিচার চায়।


খলিফা জাবালাকে তৎক্ষণাত ডেকে পাঠান এবং জিজ্ঞাসা করেন যে, অভিযোগ সত্যি কি না।


জাবালা উদ্ধত স্বরে জবাব দেন, “সম্পূর্ণ সত্য। এই পাজিটা আমার চাদর পদদলিত করে আল্লাহর ঘরের সামনে আমাকে প্রায় উলংগ করে দিয়েছে।”


খলিফা দৃঢ়তার সাথে জবাব দেন, “কিন্তু এটা ছিল একটা দুর্ঘটনা।” জাবালা স্পর্ধিত কন্ঠে বললেন, “আমি তার পরোয়া করি নে। কা’বা শরীফের সম্মানের খাতিরে ও কা’বার চত্ত্বরে রক্তপাত নিষিদ্ধ থাকার কারণে আমি যথেষ্ট ক্রোধ সংবরণ করেছি।


নচেত ওকে আমি চপেটাঘাত নয় হত্যাই করতাম।”


জাবালা হযরত ওমরের একজন শক্তিশালী মিত্র ও ব্যক্তিগত বন্ধু ছিলেন।


খলিফা তাই একটু থামলেন এবং কিছু চিন্তাভাবনা করলেন।


অতঃপর শান্ত অথচ দৃঢ় কন্ঠে বললেন, “জাবালা, তুমি নিজের অপরাধ স্বীকার করেছ। এখন বাদী ক্ষমা না করলে তোমাকে ইসলামী আইনের শাস্তি মাথা পেতে নিতে হবে এবং বাদীর হাতে পাল্টা একটি চপেটাঘাত খেতে হবে।”


স্তম্ভিত হয়ে জাবালা বললেন, “আমি একজন যোদ্ধা। আর ও হচ্ছে একজন সাধারণ কৃষক।”


হযরত ওমর(রা) বললেন, “তোমরা উভয়ে মুসলমান এবং আইনের চোখে সবাই সমান।”


জাবালা বললো, “যে ধর্মে রাজা ও একজন সাধারণ প্রজাকে সমান চোখে দেখা হয়, আমি তার আনুগত্য করতে পারি নে। ঐ চাষা যদি আমাকে চপেটাঘাত করে তবে আমি ইসলাম ত্যাগ করবো।”(নাউযুবিল্লাহ)।


হযরত ওমর ততোধিক কঠোর স্বরে জবাব দিলেন, “তোমার মত হাজার জাবালাও যদি ইসলাম ত্যাগ করে চলে যায়, তবে সেই ভয়ে ইসলামের একটি ক্ষুদ্রতম বিধিও লংঘিত হতে পারে না।


তোমাকে এ শাস্তি পেতেই হবে। আর একথাও জেনে রাখ, ইসলাম কাউকে জোরপূর্বক মুসলমান বানায় না। তোমাকেও বানায় নি। কিন্তু ইসলাম ত্যাগ করা সহজ নয়। মুরতাদের শাস্তি মৃত্যুদন্ড।”


হযরত ওমরের শেষোক্ত কথাটা শুনে জাবালা রাগে ও ভয়ে ঠকঠক করে কাঁপতে লাগলো।


হযরত ওমরের নির্দেশে বাদী তৎক্ষণাত সজোরে জাবালার মুখে ঠাস করে একটি চড় বসিয়ে দিয়ে প্রতিশোধ নিয়ে নিল।


জাবালা ক্রোধে চক্ষু লাল করে বাদীর দিকে একবার তাকালো।


অতঃপর রাগে গরগর করতে করতে কা’বার চত্ত্বর ত্যাগ করে নীরবে চলে গেল।


জানা যায়, এরপর জাবালা ইবনে আইহাম ইসলাম ত্যাগ করে প্রাণের ভয়ে সোজা রোম সম্রাটের কাছে গিয়ে আশ্রয় নেয় এবং সেখানেই জীবনের অবশিষ্ট দিনগুলি কাটায়।


রাসূলের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারকারী এক মুরতাদের শাস্তি


হযরত ইবনে আব্বাস থেকে বর্ণিত আছে যে, মদীনায় বিশর নামক একজন মুনাফিক বাস করতো।


একবার জনৈক ইহুদীর সাথে তার বিবাদ বেধে যায়।


ইহুদী বললোঃ চল, আমরা মুহাম্মদ(সা) এর কাছে গিয়ে এর মীমাংসা করে আসি। বিশর প্রথমে এ প্রস্তাবে রাজী হলো না। সে ইহুদী নেতা কা’ব ইবনে আশরাফের কাছে মীমাংসার জন্য যাওয়ার প্রস্তাব করলো।


কা’ব ইবনে আশরাফ ছিল মুসলমানদের কট্টর দুশমন।


বিস্ময়ের ব্যাপার এই যে, এই ইহুদী নেতার কাছ থেকে মীমাংসা কামনা করেছিল মুসলমান পরিচয় দানকারী বিশর। অথচ ইহুদী লোকটি স্বয়ং রাসূল এর উপর এর বিচারের ভার অর্পণ করতে চাইছিল।


আসলে এর কারণ ছিল এই যে, রাসূল(সা) এর বিচার যে পুরোপুরি ন্যায়সংগত হবে তা উভয়ে জানতো।


কিন্তু ন্যায়সংগত মীমাংসা হলে মুনাফিক হেরে যেত আর ইহুদী জয়লাভ করত।


অনেক তর্ক বিতর্কের পর শেষ পর্যন্ত ইহুদীর মতই স্থির হল।


উভয়ে রাসূল(সা) এর কাছে গিয়ে বিবাদটার মীমাংসার ভার তাঁর ওপর অর্পণ করলো।


রাসূল(সা) মামলার ব্যাপক তদন্ত চালিয়ে ইহুদীর পক্ষে রায় দিলেন এবং বিশর হেরে গেল।


সে এ মীমাংসায় অসন্তুষ্ট হয়ে ইহুদীকে এই মর্মে সম্মত করে যে, বিষয়টির চূড়ান্ত মীমাংসার জন্য তারা হযরত ওমরের নিকট যাবে।


বিশর ভেবেছিল যে, হযরত ওমর যেহেতু কাফেরদের ব্যাপারে অত্যন্ত কঠিন, তাই তিনি ইহুদীর মোকাবিলায় তার পক্ষে রায় দেবেন।


দু’জনেই হযরত ওমরের নিকট উপস্থিত হলো। ইহুদী তাঁকে পুরো ঘটনা জানালো এবং বললো, এ ব্যাপারে রাসূল(সা) যে ফায়সালা করেছেন, তা আমার পক্ষে। কিন্তু এ লোকটি তাতে সম্মত নয়।


তাই আমাকে আপনার নিকট নিয়ে এসেছে।


হযরত ওমর বিশরকে জিজ্ঞেস করলেন, ঘটনা কি এরূপ?


সে বললো, হাঁ। তখন হযরত ওমর বললেন, তাহলে একটু অপেক্ষা কর।


এই বলে তিনি ঘরের ভেতর থেকে একখানা তলোয়ার নিয়ে এলেন এবং “যে লোক রাসূলের ফায়সালা মেনে নিতে রাজী হয় না, ওমরের কাছে তার ফায়সালা হলো এই……” এই বলে চোখের নিমেষে বিশরকে দ্বিখন্ডিত করে ফেললেন।


এরপর বিশরের উত্তরাধিকারীরা রাসূল(সা) এর নিকট হযরত ওমরের(রা) বিরুদ্ধে এই বলে অভিযোগ করলো যে, তিনি শরীয়ত সম্মত কারণ ব্যতীত একজন মুসলমানকে হত্যা করেছেন।


এ সময় রাসূল(সা) এর মুখ দিয়ে স্বতঃস্ফূর্তভাবে এ কথা বেরিয়ে আসে যে, “ওমর কোনো মুসলমানকে হত্যা করার ধৃষ্টতা দেখাতে পারে এটা আমি মনে করি না।”


আসলে হযরত ওমর(রা) তাকে এই মনে করে হত্যা করেছেন যে, সে যেহেতু আল্লাহর রাসূলের ফায়সালা প্রত্যাখ্যান করেছে, তখন সে স্পষ্টতই মুরতাদ ও কাফের হয়ে গিয়েছে। ইসলামী শরীয়তে মুরতাদের সর্বসম্মত শাস্তি যে মৃত্যুদন্ড সেটাই তিনি তাকে দিয়েছেন।


আর এর অব্যাহতি পর সূরা নিসার ৬০ থেকে ৬৮ নং আয়াত নাযিল হয়ে হযরত ওমরের(রা) অভিমতকে সঠিক প্রমাণিত করে।


শিক্ষাঃ


আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূল(সা) এর আদেশ, নিষেধ বা সিদ্ধান্তকে যারা প্রকাশ্যভাবে অস্বীকার ও প্রত্যাখ্যান করে, তাদেরকে মুসলমান বলে মনে করা বৈধ নয়।


ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত থাকলে এ ধরনের লোকদের মৃত্যুদন্ড দেয়া অপরিহার্য।


অন্যথায়, এ ধরনের মুরতাদদের সমাজচ্যূত করা ও নিন্দা প্রতিবাদের মাধ্যমে কোনঠাসা করে রাখতে হবে, যাতে আর কেউ মুরতাদ হবার ধৃষ্টতা না দেখায়।


স্বামী স্ত্রীর আচরণে সহনশীলতা


বর্ণিত আছে যে, এক ব্যক্তি নিজের স্ত্রীর দুর্ব্যবহারে অতিষ্ঠ হয়ে হযরত ওমর(রা)এর নিকট নালিশ করতে ও তাঁর পরামর্শ নিতে এলো।


এসে হযরত ওমরের(রা) বাস ভবনের দরজায় দাঁড়াতেই শুনতে পেলে তাঁর স্ত্রী অত্যন্ত কর্কশ ভাষায় ও উচ্চস্বরে তাঁকে তিরস্কার করেছে, আর হযরত ওমর তা নীরবে শুনেছেন। লোকটি তৎক্ষণাত ফিরে যেতে উদ্যত হলো।


সে ভাবলো, হযরত ওমরের(রা) মত কঠোর মেজাজের মানুষের যখন এই অবস্থা এবং তিনি খলীফা, তখন আমি আর কে? ঠিক এই সময়ে হযরত ওমর বাইরে বেরিয়ে দেখলেন এক ব্যক্তি তাঁর দরজা থেকে ফিরে যাচ্ছে।


তিনি তাঁকে ডেকে ফেরালেন এবং জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কি জন্য এসেছ? সে বললোঃ “আমিরুল মোমেনীন! আমি আপনার কাছে এসেছিলাম নিজের স্ত্রীর বদমেজাজ ও কঠোর ব্যবহার সম্পর্কে নালিশ করতে। কিন্তু এসে নিজ কানে যা শুনতে পেলাম, তাতে মনে হলো আপনার স্ত্রীরও একই অবস্থা।


তাই এই স্বান্তনা নিয়ে ফিরে যাচ্ছিলাম যে, খোদ আমিরুল মোমেনীনের যখন নিজের স্ত্রীর সাথে এরূপ অবস্থা, তখন আমি আর কোথাকার কে?


হযরত ওমর(রা) বললেনঃ “ওহে দ্বীনি ভাই, শোন! আমি আমার স্ত্রীর এরূপ আচরণ সহ্য করি দুটি কারণে-


প্রথমতঃ আমার কাছে তার অনেক অধিকার পাওনা আছে।


দ্বিতীয়তঃ সে আমার খাবার রান্না করে, রুটি বানায়, কাপড় ধোয় ও আমার সন্তানকে দুধ খাওয়ায়।


অথচ এর কোনটি তার কাছে আমার প্রাপ্য নয় এবং সে এগুলো করতে বাধ্য নয়। এ সবের কারণে আমার মনে শান্তি বিরাজ করে এবং আমি হারাম উপার্জন থেকে রক্ষা পাই। এ কারণেই আমি তাকে সহ্য করি।


লোকটি বললোঃ হে আমিরুল মোমেনীন, আমার স্ত্রীও তদ্রুপ।


হযরত ওমর(রা) বললেনঃ তাহলে সহ্য করতে থাকো ভাই। দুনিয়ার জীবনতো অল্প কটা দিনের!


শিক্ষাঃ


ইসলাম যে নারীর প্রতি কত উদার ও সহনশীল হওয়ার শিক্ষা দেয় তা এই ঘটনা থেকে স্পষ্ট হয়ে যায়।


এই ঘটনা থেকে শরীয়তের এই বিধিও স্পষ্ট হয়ে যায় যে, নিছক প্রথাগতভাবে আমাদের সমাজে মনে করা হয় যে, রান্না বান্না করা, কাপড় ধোয়া ও গৃহস্থালির যাবতীয় কাজ করা স্ত্রীর দায়িত্ব ও কর্তব্য।


কিন্তু আসলে তা তার কোনো দায়িত্ব ও কর্তব্য নয়।


এ সব কাজ করা স্ত্রীর ইচ্ছাধীন।


শুধু স্বামী ও সন্তানের মঙ্গলাকাঙ্খা থেকেই স্ত্রীরা নিজের ইচ্ছায় এসব কাজ করে থাকেন।


এ সব কাজে কোনো ত্রুটি হলে সেজন্য তাকে শাস্তি বা বকাঝকা করা জায়েয নয়।


তবে স্বামীর সম্পদ ও সন্তানের রক্ষণাবেক্ষণ ও তত্ত্বাবধান অবশ্যই স্ত্রীর দায়িত্ব।


ইসলামের ওপর ওমরের দৃঢ়তা!


ইবনে ইসহাক বলেন, আবদুল্লাহ ইবনে উমারের মুক্ত গোলাম না’ফে ইবনে উমার থেকে বর্ণনা করেন যে, আমার পিতা ওমর যখন ইসলাম গ্রহণ করলেন, তখন জিজ্ঞাসা করলেন যে, কুরাইশের কোন ব্যক্তি সর্বাধিক প্রচার মুখর?


তাকে বলা হলো, জামীল বিন মুয়াম্মার আল জুমহী। তিনি তৎক্ষণাৎ তারপর রওনা হলেন।


আবদুল্লাহ ইবনে উমার বলেনঃ আমি তাঁর পেছনে পেছনে ছুটলাম এবং তিনি কি করেন দেখতে লাগলাম।


তখন আমি একজন বালক হলেও যা কিছু দেখি সবই বুঝতে পারি।


ওমর(রা) জামীলের কাছে উপস্থিত হয়ে বললেনঃ “হে জামীল! আমি ইসলাম গ্রহণ ও মুহাম্মদের ধর্মে প্রবেশ করেছি।” ইবনে ওমর বলেন, জামীল তাঁর দিকে ভ্রুক্ষেপ না দিয়ে চাদর গুটিয়ে হাঁটতে লাগল।


ওমর(রা) তার পিছু পিছু চললেন। আমিও আমার পিতার পিছু পিছু চললাম। চলতে চলতে মসজিদুল হারামের দরজার কাছে পৌঁছে সে বিকট চিৎকার করে বললো, “হে কুরাইশ জনমন্ডলী! শুনে নাও, ওমর ধর্মচ্যূত হয়ে গেছে।” এ সময় কুরাইশ নেতৃবৃন্দ কা’বার চত্ত্বরে তাদের আড্ডায় বসেছিল।


ওমর তার পেছনে দাঁড়িয়ে বললেনঃ “জামীল মিথ্যা বলছে, আমি ধর্মচ্যূত হইনি, ইসলাম গ্রহণ করেছি। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে আল্লাহ ছাড়া আর কোনো ইলাহ নেই এবং মুহাম্মাদ(সা) তার বান্দা ও রাসূল।” সঙ্গে সঙ্গে সকলে তার দিকে মারমুখী হয়ে ছুটে এল। ওমর ও কুরাইশ জনতার মধ্যে লড়াই চললো দুপুর পর্যন্ত। এক সময় ওমর ক্লান্ত ও অবসন্ন হয়ে বসে পড়লেন।


মারমুখী জনতা তখনো তাঁর মাথার উপরে। ওমর বলতে লাগলেনঃ তোমরা যা খুশী কর। আল্লাহর কসম, আমরা যদি তিনশো লোক হতাম, তাহলে আমরা তোমাদের জন্য রণাঙ্গন ছেড়ে দিতাম অথবা তোমরা ছেড়ে দিতে।”(অর্থাৎ মুসলমানদের সংখ্যা বেশি হলে তোমরা এত মারমুখী হতে না)। উভয়পক্ষ যখন এই পর্যায়ে, তখন সহসা সেখানে একজন প্রবীণ কুরাইশ সর্দারের আবির্ভাব ঘটলো। মূল্যবান ইয়ামানী চাদর ও নকশাদার আলখেল্লা পরিহিত এই বৃদ্ধ এসে তাদের পাশে দাঁড়ালেন।


তিনি জিজ্ঞেস করলেনঃ তোমাদের কি হয়েছে? তারা বললো, “ওমর ধর্মচ্যূত হয়ে গেছে।” বৃদ্ধ বললেন, “তাতে কী? থামো। একজন মানুষ নিজের ইচ্ছায় একটি জিনিস গ্রহণ করেছে। তোমরা তার কি করতে চাও? তোমরা কি ভেবেছ, বনু আদি বিন কা’ব[ওমর(রা) এর গোত্র] তাদের সদস্যকে তোমাদের হাতে এভাবেই ছেড়ে দেবে? ওকে ছেড়ে দাও।”


ইবনে উমার(রা) বললেনঃ এ কথার পর তারা নিজেদের উত্তেজিত ভাবাবেগকে সংযত করলো। পরে মদীনায় হিজরত করার পর আমার পিতাকে জিজ্ঞাসা করেছিলামঃ আব্বা, ঐ বৃদ্ধটি কে, যিনি আপনার ইসলাম গ্রহণের দিন মারমুখো জনতাকে আপনার কাছ থেকে ধমক দিয়ে হটিয়ে দিয়েছিলেন? তিনি বললেন, তিনি আস ইবনে ওয়ায়েল আসসাহমী।


ইবনে হিশাম বলেনঃ আমাকে কোনো কোনো বিদ্বান ব্যক্তি বলেছেন যে, আবদুল্লাহ ইবনে ওমর ও তাঁর পিতার কথোপকথনটি ছিল এরককঃ


ইবনে ওমরঃ আব্বা! ঐ লোকটি কে, যিনি আপনার ইসলাম গ্রহণের দিন মক্কাতে যারা আপনার ওপর আক্রমণ করেছিল, তাদেরকে ধমক দিয়ে থামিয়ে দিয়েছিলেন? আল্লাহ উনাকে উত্তম প্রতিদান দিন।”


হযরত ওমর(রা)ঃ “হে বৎস্য! তিনি আস ইবনে ওয়ায়েল।


আল্লাহ তাকে কোনোই উত্তম প্রতিদান যেন না দেন।” কারণ ইসলাম গ্রহণ ব্যতীত ভালো কাজের প্রতিদান পাওয়া যায়না। আ’স ইবনে ওয়ায়েল মোশরেক অবস্থায় এ কাজটি করেন এবং কখনো মুসলমান হন নি।


হযরত ওমর(রা) বলেনঃ “সেই রাত্রে ইসলাম গ্রহণ করার পর সিদ্ধান্ত নিলাম যে মক্কাবাসীর মধ্যে যে ব্যক্তি রাসূল(সা) এর সবচেয়ে কট্টর দুশমন, তার কাছে যাবো এবং তাকে জানাবো যে, আমি মুসলমান হয়ে গেছি।


ভেবে দেখলাম যে এই ব্যক্তিটি তো আবু জাহল ছাড়া আর কেউ নয়।” উল্লেখ্য যে, ওমর(রা) আবু জাহলের আপন বোন খানতামা বিনতে হিশাম ইবনুল মুগীরার পুত্র ছিলেন। যাহোক, ওমর বললেনঃ আমি পরদিন সকালে তার কাছে গিয়ে দরজায় কড়া নাড়লাম। আবু জাহল আমার কাছে বেরিয়ে এলো এবং বললোঃ “আমার ভাগ্নেকে স্বাগত! তুমি কি খবর নিয়ে এসেছ ওমর?”


আমি বললাম, “মামা, আমি আপনাকে জানাতে এসেছি যে, আমি আল্লাহ ও তাঁর রাসূল মুহাম্মদ(সা) এর প্রতি ঈমান এনেছি।


তিনি যে বিধান নিয়ে এসেছেন তাও সত্য বলে মেনে নিয়েছি।” এরপর তিনি আমার মুখের উপর ঠাস করে দরজা বন্ধ করে দিলেন এবং বললেনঃ “ধিক তোমাকে এবং ধিক তোমাকে বহন করে আনা সংবাদকে।”


হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ বলেনঃ হযরত ওমরের(রা) ইসলাম গ্রহণ করা ছিল একটি বিজয়, তাঁর মদীনায় হিজরত ছিল আল্লাহর সাহায্য স্বরূপ এবং তাঁর খিলাফত ছিল আল্লাহর রহমত স্বরূপ।


শিক্ষাঃ


(১) পবিত্র কুরআন অধ্যয়ন করেই হযরত ওমর(রা) হেদায়াত লাভ করেছিলেন।


তাই ইসলামের পুনরুজ্জীবন ও পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য যারাই কাজ করতে চায়, কেয়ামত পর্যন্ত তাদের এ কাজ সরাসরি কুরআন দিয়েই শুরু করতে হবে।


(২) রাসূল(সা) ওমরের নাম ধরে দোয়া করতেন তাঁর হেদায়াতের জন্য।


তাই রাসূল(সা) এর পদানুসরণ করে আমাদেরও ইসলামের শত্রুদের হেদায়াতের জন্য নাম ধরে দোয়া করা উচিত।


শুধু প্রচার ও শিক্ষা দান করেই ক্ষান্ত থাকা উচিত নয়। কেননা হেদায়াতের আসল চাবিকাঠি আল্লাহর হাতে রয়েছে।


(৩) আবিসিনিয়ায় হিজরতের পর মক্কার অবস্থান ছিল চরম নৈরাশ্যজনক।


কিন্তু এহেন পরিস্থিতিতেও আল্লাহ তায়ালা হযরত ওমরের(রা) মত ব্যক্তিত্বকে ইসলাম গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন।


সুতরাং কোনো পরিস্থিতিতেই মুসলমানদের হতাশ হওয়া উচিত নয়। আল্লাহ তায়ালা অকল্পনীয়ভাবে সাহায্য পাঠাতে পারেন।


ওমর ইবনুল খাত্তাবের ইসলাম গ্রহণ সম্পর্কে আতা ও মুজাহিদের বর্ণনা


ইবনে ইসহাক বলেন, আবদুল্লাহ ইবনে আবি নুজাইহ আল মাক্কী স্বীয় শিষ্য আতা, মুজাহিদ অথবা অন্যান্য বর্ণনাকারীদের থেকে বর্ণনা করেছেন যে,


ওমর(রা) এর ইসলাম গ্রহণ সম্পর্কে ব্যাপক জনশ্রুতি রয়েছে যে তিনি স্বয়ং নিম্নরূপ বলতেনঃ “ আমি ইসলামের কট্টর বিরোধী ছিলাম। জাহেলী যুগে আমি খুব মদের ভক্ত ছিলাম। মদ পেলে খুবই আনন্দিত হতাম।


আমাদের একটা মজলিশ বসতো উমার বিন আবদ বিন ইমরান আল মাখযুমীর পারিবারিক বাসস্থানের নিকটস্থ খাজওয়ারা নামক স্থানে। সেখানে কুরাইশের বহু লোক সমবেত হতো। একদিন রাতে ঐ আসরে আমার আমার সহযোগীদের উদ্দেশ্যে গেলাম। কিন্তু তাদের কাউকেই পেলাম না। এরপর ভাবলাম, মক্কার অমুক মদ বিক্রেতার কাছে গেলে হয়তো মদ খেতে পারতাম।


তার উদ্দেশ্যে গেলাম। কিন্তু তাকে পেলামনা। এরপর মনে মনে বললাম, কা’বা শরীফে গিয়ে সাতবার অথবা সত্তরবার যদি তওয়াফ করতাম, মন্দ হতো না। অতঃপর কা’বা শরীফে তাওয়াফ করার জন্য মসজিদুল হারামে উপনীত হলাম।


সেখানে দেখলাম, রাসূলুল্লাহ(সা) নামাযে দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি তখনো সিরিয়ার দিকে মুখ করে নামায পড়তেন। নিজের ও সিরিয়ার মাঝখানে কা’বা শরীফকে রাখতেন। রূকনে আসওয়াদ ও রূকনে ইয়ামানীর মাঝে বসে তিনি নামায পড়তেন।


তাঁকে দেখেই আপন মনেই বললাম, আল্লাহর কসম, আজকের রাতটি যদি মুহাম্মাদের(সা) আবৃত্তি শুনে কাটিয়ে দিতাম এবং সে কি বলে তা অবহিত হতাম, তাহলেও কাজ হতো।


কিন্তু সেই সাথে এটাও ভাবলাম যে, মুহাম্মদের(সা) খুব কাছে গিয়ে যদি শুনি তাহলে তিনি ভয় পেয়ে যাবেন। তাই হাজরে আসওয়াদের দিক থেকে এলাম, কা’বা শরীফের পর্দার আড়ালে লুকিয়ে ধীর পায়ে এগিয়ে এলাম।


রাসূল(সা) তখনো যথারীতি দাঁড়িয়ে নামাযে কুরআন পাঠ করে যাচ্ছেন। অবশেষে আমি তাঁর ঠিক সামনে কা’বার পর্দার আড়ালে লুকিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। যখন কুরআন শুনলাম, আমার মন নরম হয়ে গেল। আমি কেঁদে দিলাম। ইসলাম আমার মনমগজ দখল করে ফেললো। রাসূল(সা) নামায শেষ করে চলে না যাওয়া পর্যন্ত আমি ওখানেই চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম।


তিনি যখন কা’বা থেকে যেতেন, ইবনে আবি হুসাইনের বাড়ির কাছ দিয়ে যেতেন। এই বাড়ী ছিল তার সাফা ও মারওয়ার দৌড়েরও শেষ সীমা। সেখান থেকে আব্বাস ইবনে আবদুল মুত্তালিবের বাড়ী এবং আজহার বিন আবদ আওফ আযযুহরীর বাড়ির মাঝখান দিয়ে, তারপর আখনাস বিন শুরাইকের বাড়ী হয়ে নিজের বাড়ীতে চলে যেতেন।


দারুর রাকতাতে ছিল রাসূল(সা) এর বাড়ী। এই জায়গাটি ছিল আবু সুফিয়ানের ছেলে মুয়াবীয়ার মালিকানাধীন। ওমর(রা) বললেন, আমি রাসূল(সা) এর পিছু পিছু চলতে লাগলাম। যখন তিনি আব্বাসের বাড়ী ও ইবনে আযহারের বাড়ীর মাঝখানে গিয়ে পৌছলেন, তখন তাঁকে গিয়ে ধরলাম। আমার আওয়ায শুনেই রাসূল(সা) আমাকে চিনে ফেললেন।


রাসূল(সা) মনে করলেন আমি তাঁকে কষ্ট দিতে এসেছি। তাই তিনি আমাকে একটা ধমক দিলেন। ধমক দিয়েই আবার জিজ্ঞাসা করলেন, “ওহে খাত্তাবের পুত্র! এ মুহুর্তে তুমি কি উদ্দেশ্যে এসেছ?” আমি বললাম, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি এবং তাঁর কাছে যা কিছু আল্লাহর কাছ থেকে আসে, তার প্রতি ঈমান আনার উদ্দেশ্যে।” এ কথা শুনে রাসূল(সা) আল্লাহর প্রশংসা ও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করলেন।


তারপর বললেন, “হে ওমর! আল্লাহ তোমাকে হেদায়াত করেছেন।” তারপর তিনি আমার বুকে হাত বুলালেন এবং আমি যাতে ইসলামের উপর অবিচল থাকি সে জন্য দোয়া করলেন।


অতঃপর রাসূল(সা)এর কাছ হতে বিদায় হলাম এবং তিনি নিজের বাড়ীতে প্রবেশ করলেন।”


ইবনে ইসহাক বলেনঃ ওমরের ইসলাম গ্রহণ সম্পর্কে উপরের দুটি ঘটনার মধ্যে কোনটি সঠিক তা আল্লাহই ভালো জানেন।


হযরত ওমরের (রাঃ) ইসলাম গ্রহণের কারণ


ইবনে ইসহাক হতে বর্ণিত আছে যে, ‘ওমরের বোন ফাতিমা বিনতে খাত্তাব ও তার স্বামী সাঈদ বিন যায়েদ বিন আমর বিন নুফায়েল ওমরের আগেই ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন।


কিন্তু তাঁরা তাঁদের ইসলাম গ্রহণের কথা ওমরের কাছ হতে লুকিয়ে রেখেছিলেন।


মক্কার আর এক ব্যক্তি নাঈম বিন আবদুল্লাহ আন নাহামও একইভাবে গোপনে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। ওমরের স্বগোত্রীয় অর্থাৎ বনু আদি বিন কা’বের অন্তর্ভুক্ত এই ব্যক্তি নিজ গোত্রের অত্যাচারের ভয়ে নিজের ইসলাম গ্রহণের কথা প্রকাশ করেন নি।


খাব্বার ইবনুল আরাত(বনু তামীম বংশোদ্ভূত এই সাহাসী জাহিলিয়াতের যুগে তরবারী তৈরির পেশায় নিয়োজিত ছিলেন এবং বনু খোযায়া গোত্রের উম্মে আনমার নাম্মী মহিলার মুক্ত গোলাম ছিলেন) নামক অপর এক নওমুসলিম গোপনে ফাতিমা বিনতে খাত্তাবকে কুরআন পড়িয়ে যেতেন।


একদিন ওমর ইবনুল খাত্তাব উন্মুক্ত তরবারী হাতে নিয়ে রাসূল(সা) ও তাঁর একদল সাহাবীর সন্ধানে বেড়িয়ে পড়লেন।


তিনি জানতে পেরেছিলেন যে, প্রায় ৪০ জন নারী ও পুরুষ সাহাবীসহ রাসূল(সা) সাফা পাহাড়ের নিকটবর্তী একটা ঘরে সমবেত হয়েছেন।


রাসূল(সা) এর তাঁর চাচা হামযা ইবনে আবদুল মুত্তালিব, আবু বকর সিদ্দীক বিন আবু কুহাফা এবং আলী বিন আবু তালিবসহ এমন কিছু সংখ্যক মুসলমান ছিলেন যারা রাসূল(সা) এর সাথে মক্কায় অবস্থান করছিলেন এবং আবিসিনিয়ায় হিজরতকারীদের সাথে হিজরত করেন নি।’ পথে নাঈম বিন আবদুল্লাহর সাথে ওমরের(রা) দেখা হলো।


তিনি বললেন, কোথায় চলেছ ওমর? ওমর বললেন, “ধর্মচ্যূত মুহাম্মদের সন্ধানে চলেছি, যে কুরাইশ বংশে বিভেদ সৃষ্টি করেছে, তাদের বুদ্ধিমানদের বোকা সাব্যস্ত করেছে, তাদের অনুসৃত ধর্মের নিন্দা করেছে এবং তাদের দেবদেবীকে গালাগাল করেছে। আমি ওকে হত্যা করবো।” নাঈম বললেন, “ওহে ওমর, আল্লাহর কসম, তুমি আত্মপ্রবঞ্চনার শিকার হয়েছ।


তুমি কি মনে কর, মুহাম্মদকে হত্যা করার পর বনু আবদ মানাফ তোমাকে ছেড়ে দেবে আর তুমি পৃথিবীর ওপর অবাধে বিচরণ করে বেড়াতে পারবে? তোমার কি উচিত নয় আগে পরিবার পরিজনের দিকে মনোনিবেশ করা এবং তাদেরকে শোধরানো?” ওমর বললেনঃ “আমার পরিবার পরিজনের কি হলো?” নঈম বললেন, “তোমার ভগ্নিপতি ও চাচাতো ভাই সাঈদ বিন যায়েদ বিন আমর এবং তোমার বোন ফাতিমা বিনতে খাত্তাব।


আল্লাহর কসম, তাঁরা উভয়ে ইসলাম গ্রহণ করেছে এবং মুহাম্মদের ধর্ম অনুসরণ করেছে।


পারলে তাদেরকে সামলাও।” ওমর তৎক্ষণাৎ ফিরে গেলেন তার বোন ও ভগ্নিপতির বাড়ির দিকে। যখন তিনি তাদের কাছে রওনা হলেন তখন তাদের কাছে খাব্বাব ইবনুল আরাত ছিলেন। তিনি তাদেরকে পবিত্র কুরআনের একটি অংশ হাতে নিয়ে পড়াচ্ছিলেন। এই অংশটিতে ছিল সূরা ত্বা-হা। ওমরেরর আওয়াজ শুনে খাব্বাব গা ঢাকা দিলেন।


তিনি ঘরের কোন এক অংশে লুকিয়ে রইলেন। আর ফাতেমা কুরআনের কোনো একটি অংশ নিজের উরুর নিচে চাপা দিয়ে রইলেন। ঘরের কাছাকাছি পৌঁছার পর ওমর খাব্বাবের পড়ার আওয়াজ শুনেছিলেন।


ঘরে ঢুকে তিনি বললেন, “একটি দুর্বোধ্য বাণী আবৃত্তি করার আওয়াজ শুনেছিলাম।


ওটা কি?” তাঁরা উভয়ে বললেন, “না, আপনি কিছুই শুনেন নি।” ওমর বললেন, “নিশ্চয়ই শুনেছি। আর আল্লাহর কসম, এটাও জেনেছি যে, তোমরা উভয়ই মুহাম্মদের অনুসারী হয়ে গেছ।” কথাটা বলে ভগ্নিপতি সাঈদকে প্রবলভাবে জাপটে ধরলেন। তার বোন ফাতিমা বিনতে খাত্তাব স্বামীকে বাঁচাতে ছুটে গেলে তিনি তাকে মেরে জখম করে দিলেন।


এই কান্ড ঘটানোর পর তাঁর বোন এবং ভগ্নিপতি একযোগে বলে উঠলেন, “হ্যাঁ, আমরা ইসলাম গ্রহণ করেছি। আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান এনেছি। এখন যা করতে চান করুন।” ওমর যখন দেখলেন তার বোনের শরীর রক্তাক্ত, তখন অনুতপ্ত হলেন। তিনি স্বীয় বোনকে বললেন, “আমাকে এই পুস্তিকাটি দাও, যা এইমাত্র তোমাদেরকে পড়তে শুনলাম।


আমি একটু দেখবো মুহাম্মাদ কি জিনিস নিয়ে এসেছে।” ওমর লেখাপড়া জানা লোক।


তিনি একথা বললে তাঁর বোন তাঁকে বললেন, “আমার ভয় হয় আপনি নষ্ট করে ফেলেন কি না।” ওমর বললেন, “ভয় পেয়ো না।” অতঃপর তিনি নিজের দেবদেবীর শপথ করে বললেন, “ওটি আমি পড়েই তোমার কাছে ফিরিয়ে দেবো।”


ওমরের এ কথাটি শুনে ফাতেমার মনে আশার সঞ্চার হলো যে, ওমর ইসলাম গ্রহণ করতে পারে। তিনি বললেন, “ভাইজান! আপনি যে অপবিত্র! কেননা আপনি এখনো মোশরেক। অথচ এই পবিত্র গ্রন্থকে পবিত্র ব্যক্তি ছাড়া স্পর্শ করতে পারে না।” ওমর তৎক্ষণাৎ উঠে চলে গেলেন এবং গোসল করে এলেন। এবার ফাতিমা তাকে পুস্তিকাখানি দিলেন।


তাতে সূরা ত্বা-হা লিখিত ছিল। তিনি তা পড়লেন।


প্রথম অংশটি পড়েই বললেনঃ “আহ্! কি সুন্দর কথা! কী মহৎ বাণী!” তাঁর এ উক্তি শুনে খাব্বা তাঁর সামনে বেরিয়ে এলেন। তিনি তাঁকে বললেন, “হে ওমর! আল্লাহর কসম, আমার মনে আশা সঞ্চার হচ্ছে যে আল্লাহ হয়তো আপনাকে তাঁর নবীর দাওয়াত গ্রহণের জন্য মনোনীত করেছেন।


আমি গতকাল শুনলাম রাসূল(সা) দোয়া করেছেন, “ হে আল্লাহ! আবুল হিকাম বিন হিশাম অথবা ওমর ইবনুল খাত্তাবের দ্বারা ইসলামের শক্তি বৃদ্ধি কর।


অতএব, আল্লাহর দিকে অগ্রসর হোন, আল্লাহর দিকে অগ্রসর হোন, হে ওমর।”


ওমর বললেন, “হে খাব্বাব! আমাকে মুহাম্মদের সন্ধান দাও।


আমি তাঁর কাছে যেয়ে ইসলাম গ্রহণ করবো।” খাব্বাব বললেন, “তিনি সাফা পাহাড়ের নিকট একটি বাড়িতে আছেন। সেখানে তাঁর সাথে তাঁর একদল সাহাবী রয়েছেন।” ওমর তাঁর তরবারী আগের মতই খোলা অবস্থায় ধরে নিয়ে রাসূল(সা) ও তাঁর সাহাবীদের কাছে চললেন।


সেখানে গিয়ে দরজায় কড়া নাড়লেন। ভেতর থেকে তাঁর আওয়াজ শুনে রাসূল(সা) এর জনৈক সাহাবী দরজার কাছে এগিয়ে গিয়ে ভেতর থেকে তাকালেন। দেখলেন ওমর মুক্ত তরবারী হাতে দাঁড়িয়ে। তিনি শংকিত চিত্তে রাসূল(সা) এর কাছে গিয়ে বললেন, “হে রাসূলুল্লাহ! এ যে ওমর ইবনুল খাত্তাব একেবারে নগ্ন তরবারী হাতে!” হামযা ইবনে আবদুল মুত্তালিব বললেন, “ওকে ভিতরে আসার অনুমতি দিন। সে যদি কোনো শুভ কামনা নিয়ে এসে থাকে, আমরা তার প্রতি বদান্যতা দেখাব।


আর যদি কোনো কু-বাসনা নিয়ে এসে থাকে তাহলে ওর তরবারী দিয়েই ওকে হত্যা করবো।” রাসূল(সা) বললেন, “ওকে ভেতরে আসতে দাও।” উক্ত সাহাবী তাকে ভেতরে আসতে দিলেন।


রাসূল(সা) নিজে উঠে তার কাছে এগিয়ে গেলেন এবং নিজের কক্ষে নিয়ে গিয়ে তার সাথে সাক্ষাৎ করলেন। রাসূল(সা) তার পাজামা বাঁধার জায়গা অথবা যেখানে চাদরের দুই কোণা মিলিত হয়, সেখানটা ধরে তাঁকে প্রচন্ডজোরে আকর্ষণ করলেন এবং বললেন, “কি হে খাত্তাবের পুত্র! তোমার এখানে আগমন ঘটলো কিভাবে?


আমার তো মনে হয়, আল্লাহ তোমার ওপর কোনো বিপর্যয় না নামানো পর্যন্ত তুমি ফিরবে না।”


ওমর বললেন, “ হে রাসূলুল্লাহ! আমি আপনার কাছে এসেছি আল্লাহর ওপর, তাঁর রাসূলের ওপর ও আপনার কাছে আল্লাহর পক্ষ হতে যা কিছু আসে তার ওপর ঈমান আনবার জন্য।” এ কথা শুনামাত্র রাসূল(সা) এমন জোরে “আল্লাহু আকবার” বলে উঠলেন যে, ঐ ঘরের ভেতর রাসূল(সা) এর যে কয়জন সাহাবী ছিলেন সবাই বুঝলেন যে, ওমর ইসলাম গ্রহণ করেছে।


এরপর রাসূল(সা) এর সাহাবীগণ যার যার জায়গায় চলে গেলেন।


হামযার পর ওমর(রা) এর ইসলাম গ্রহণে তাঁদের মনোবল ও আত্মমর্যাদা বেড়ে গেল।


তারা নিশ্চিত হলেন যে, ওঁরা দুজন রাসূল(সা) এর প্রতিরক্ষায় অবদান রাখবেন এবং ইসলামের দুশমনদের মোকাবিলায় মুসলমানদের সহযোগিতা করবেন।


এটি তাঁর ইসলাম গ্রহণ সংক্রান্ত সবচেয়ে প্রসিদ্ধ বর্ণনা।


হযরত ওমর(রা) এর ইসলাম গ্রহণ!


ইবনে ইসহাক থেকে বর্ণিত আছে যে, কুরাইশ প্রতিনিধি আমর ইবনুল আ’স ও আব্দুল্লাহ ইবনে রবীয়া’ যখন আবিসিনিয়া থেকে ফিরে এল এবং সেখানে হিযরত করতে যাওয়া মুসলমানদের ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হলো না, তার অল্প কয়েকদিন পরেই ওমর বিন খাত্তাবের ন্যায় দুর্দান্ত সাহসী ও প্রতাপশালী ব্যক্তি ইসলাম গ্রহণ করেন।


তাঁর ও হযরত হামযার ইসলাম গ্রহণে রাসূল(সা) ও সাহাবীগণের মনোবল যথেষ্ট বেড়ে যায় এবং তারা অপেক্ষাকৃত নিরাপদ অনুভব করেন। এর আগে তাঁরা কাবার চত্ত্বরে নামায পড়ারও সাহস পেতেন না।


ইসলাম গ্রহণের পর ওমর ঝুঁকি নিয়ে কাবার চত্তরে নামায পড়েন এবং তাঁর সাথে অন্যান্য সাহাবীগণও নামায পড়েন।


উম্মে আবদুল্লাহ বিনতে আবু খাসয়ামা(রা) বলেন যে, আমরা একে একে সবাই আবিসিনিয়ায় চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম।


আমার স্বামী আমের তখন একটা পারিবারিক কাজে বাইরে গিয়েছিলেন।


সহসা ওমর ইবনুল খাত্তাব এসে আমার সামনে দাঁড়ালেন।


তখনো তিনি মোশরেক। তার জুলুম অত্যাচারে আমরা অতিষ্ঠ ছিলাম।


ওমর বললেনঃ হে উম্মে আবদুল্লাহ! আপনারা বুঝি বিদায় হচ্ছেন? আমি বললামঃ হ্যাঁ, আল্লাহর কসম। আল্লাহর পৃথিবীতে বেড়িয়ে পড়বো। তোমরা আমাদেরকে অনেক কষ্ট দিয়েছ, অনেক নির্যাতন চালিয়েছ।


আল্লাহ এ অবস্থা থেকে আমাদের উদ্ধার করবেন।


ওমর বললেনঃ “আল্লাহ আপনাদের সাথী হোন।” তার কথায় এমন একটা সহানুভূতির ভাব পরিলক্ষিত হচ্ছিল যা আর কখনো দেখি নি। এরপর ওমর ইবনুল খাত্তাব চলে গেলেন। তবে আমার মনে হচ্ছিল, আমার দেশ ত্যাগের খবরে তিনি মর্মাহত।


কিছুক্ষণ পর আমের প্রয়োজন সেরে ঘরে ফিলে এলো।


আমি তাকে বললামঃ “ওহে আবদুল্লাহর বাবা! এই মাত্র ওমর এসেছিল।


আমাদের প্রতি তার সে কি সহানুভূতি ও উদ্বেগ, তা যদি তুমি দেখতে!”


আমের বললেনঃ তুমি তার ইসলাম গ্রহণের ব্যাপারে আশাণ্বিত? আমি বললামঃ হ্যাঁ। সে বললোঃ খাত্তাবের গাধা ইসলাম গ্রহণ করলেও তুমি যাকে দেখেছ সে(খাত্তাবের ছেলে ওমর) ইসলাম গ্রহণ করবে না।


ইসলামের প্রতি ওমরের যে প্রচন্ড বিদ্বেষ, হঠকারিতা ও একগুঁয়েমির প্রকাশ দেখা যাচ্ছিল, তার দরুণ


ব্যক্তিস্বাধীনতা ও বাক স্বাধীনতা


হযরত ওমর(রা) তখন মুসলিম জাহানের খলিফা।


একবার রাতের বেলা একটা সুরেলা আওয়াজ শুনতে পেলেন। একটি লোক গান গাইছিলো।


তাঁর সন্দেহ হলো। তিনি প্রাচীরে উঠে দেখলেন, পাশের ঘরে এক পুরুষ বসে আছে।


তার পাশে মদ ভর্তি একটি পাত্র ও গ্লাস। অদূরে এক মহিলাও রয়েছে।


খলিফা চিৎকার করে বললেন, ওরে আল্লাহর দুশমন! তুই কি মনে করেছিস যে, তুই আল্লাহর নাফরমানী করবি, আর তিনি তোর গোপন অভিসারের কথা ফাঁস করবেন না? জবাবে সে বললোঃ “আমিরুল মোমেনীন, তাড়াহুড়ো করবেন না।


আমি যদি একটি গুনাহও করে থাকি, তবে আপনি করেছেন তিনটি গুনাহ।


আল্লাহ তায়ালা মানুষের দোষত্রুটি খুঁজে বেড়াতে নিষেধ করেছেন কিন্তু আপনি দোষ ত্রুটি খুঁজছেন।


আল্লাহ আদেশ দিয়েছেন কারো বাড়িতে ঢুকলে দরজা দিয়ে ঢুকতে, কিন্তু আপনি প্রাচীর ডিঙ্গিয়ে ঘরে প্রবেশ করেছেন।


আল্লাহ নির্দেশ দিয়েছেন যে, নিজের বাড়ি ছাড়া অন্যের বাড়িতে অনুমতি না নিয়ে ঢুকতে।


কিন্তু আপনি আমার অনুমতি ছাড়াই আমার বাড়িতে প্রবেশ করেছেন।”


এ জবাব শুনে হযরত ওমর(রা) নিজের ভুল স্বীকার করলেন এবং তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করলেন না।


তবে তার কাছ হতে অংগীকার আদায় করলেন যে, সে পাপের পথ ত্যাগ করে সৎ পথে ফিরে আসবে।


শিক্ষাঃ অন্যায়ের প্রতিরোধে সক্রিয় থাকা প্রত্যেক মুসলিমের সার্বক্ষণিক দায়িত্ব।


কিন্তু এই দায়িত্ব পালনেও অনেক সতর্কতা ও বিচক্ষণতার পরিচয় দিতে হয়।


নচেৎ প্রতিরোধের চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যেতে পারে।


হযরত ওমরের(রা) ঘটনা থেকে সেই শিক্ষাই পাওয়া যায়।


হযরত আবু বকরের (রা) জনসেবা


হযরত আবু বকর(রা) কে খলীফা নিযুক্ত করা হয়েছে একথা যখন ঘোষণা করা হলো তখন মহল্লার একটি গরীব মেয়ে অস্থির হয়ে পড়ল।


লোকেরা জিজ্ঞেস করলো যে, আবু বকর(রা) খলীফা হয়েছেন, তাতে তোমার কি অসুবিধা হয়েছে? মেয়েটি বললো, “আমাদের ছাগলগুলোর কী হবে?” জিজ্ঞেস করা হলো, “এর অর্থ?” সে বললো, এখনতো উনি খলীফা হয়ে গেছেন।


আমাদের ছাগল ক’টার দেখাশোনাই বা কে করবে, এগুলোর দুধই বা কে দুইয়ে দিবে? এ কথার কেনো জবাব দেয়া কারো পক্ষেই সম্ভব হলো না। কিন্তু পরদিন খুব ভোরে মেয়েটি অবাক হয়ে দেখলো যে, হযরত আবু বকর(রা) যথাসময়ে তাদের বাড়ি গিয়েছেন এবং দুধ দোহাচ্ছেন।


আর যাওয়ার সময় বলে গেলেন, “মা, তুমি একটুও চিন্তা করো না।


আমি প্রতিদিন এভাবেই তোমার কাজ করে দিয়ে যাবো।” তাবাকাতে ইবনে সাদে আছে যে, মেয়েটির বিচলিত হওয়ার সংবাদ শুনে হযরত আবু বকর(রা) বলেছিলেন, আমি আশা করি খেলাফতের দায়িত্ব আমার আল্লাহর বান্দাদের সেবার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াবে না।


আমি এখনো এ দরিদ্র মেয়েটির ছাগল দোহন করে দিয়ে আসবো ইনশাল্লাহ।


ইবনে আসাকার লিখেছেন যে, আবু বকর(রা) খেলাফতের পূর্বে তিন বছর এবং খেলাফতের পরে এক বছর পর্যন্ত মহল্লার দরিদ্র পরিবারগুলির ছাগল দোহন করে দিয়ে আসতেন।


আবু ছালেহ গিফারী বর্ণনা করেন যে, হযরত আবু বকর(রা) যখন খলীফা হন তখন মদীনার এক অন্ধ বুড়ীর বাড়ির কাজকর্ম হযরত ওমর(রা) স্বহস্তে করে দিতেন। তার প্রয়োজনীয় পানি এনে দিতেন ও বাজার সওদা করে দিতেন।


একদিন ওমর সেখানে গিয়ে দেখেন বুড়ীর বাড়ি একদম পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন।


কলসিতে পানি আনা হয়েছে, বাজারও করা হয়েছে। তিনি ভাবলেন, বুড়ীর কোনো প্রতিবেশি হয়তো কাজগুলো করে দিয়ে গেছে। পরদিনও দেখলেন একই অবস্থা। সব কাজ সম্পন্ন হয়ে গেছে। এভাবে কয়েকদিন কেটে গেল।


এবার হযরত ওমরের কৌতুহল হলো। ভাবলেন, এই মহানুভব ব্যক্তিটি কে তা না দেখে ছাড়বেন না।


একদিন নির্দিষ্ট সময়ের অনেক আগে এসে লুকিয়ে রইলেন।


দেখলেন অতি প্রত্যুষে এক ব্যক্তি বুড়ীর বাড়ির দিকে দ্রুতগতিতে এগিয়ে আসছেন। হযরত ওমর বুঝতে পারলেন যে, এই ব্যক্তিই সেই মহান ব্যক্তি যিনি তারও আগে এসে বুড়ীর সমস্ত কাজ সেরে দিয়ে যান।


ব্যক্তিটি বুড়ীর ঘরের মধ্যে এসে যখন কাজ শুরু করে দিল তখন হযরত ওমর যেয়ে দেখেন, ইনি আর কেউ নন, স্বয়ং খলীফা হযরত আবু বকর(রা)। হযরত ওমর বললেন, হে রাসূলের প্রতিনিধি!


মুসলিম জাহানের শাসন সংক্রান্ত দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি এই বুড়ীর তদারকীও চালিয়ে যেতে চান নাকি? হযরত আবু বকর(রা) জবাব না দিয়ে একটু মুচকি হেসে যথারীতি কাজ করতে লাগলেন।


শিক্ষাঃ


সাধারণত উচ্চপদস্থ লোকেরা অন্যের কাজ করা দূরে থাক, নিজের কাজও করতে চায় না। চাকর চাকরানী ও যন্ত্রের মাধ্যমে সব কাজ সারতে চেষ্টা করে। হযরত আবু বাকরের হাতে দাস দাসীর অভাব ছিল না।


উপকারের কাজটা কোনো ভৃত্যকে পাঠিয়ে দিয়েও করাতে পারতেন।


কিন্তু আখেরাতের বাড়তি সাওয়াবের আশায় এবং সাধারণ মুসলমানদের জন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করার মানসে এভাবে স্বহস্তে অন্যের সেবা করেছেন সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পদে আসীন থাকা অবস্থায়।


সকল যুগের মুসলমানদের সকল পর্যায়ের উচ্চপদস্থ ব্যক্তিবর্গের জন্য এটি একটি চমকপ্রদ অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত।


খলিফা হযরত ওমর (রা) আখলাক


খলিফা হওয়ার পর হযরত ওমর(রা) রাত জেগে এ বলে কাঁদতেন যে, আল্লাহর কসম, আমার


শাসনকালে ছাগলও যদি নদীর কিনারে অযত্নে পড়ে থাকে, তবে আমার আশংকা হয় যে, কিয়ামতের দিন তার


সম্পর্কে আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।


একদিন তিনি একজন সঙ্গীকে নিয়ে কোথাও যাচ্ছিলেন।


পথিমধ্যে এক মহিলা তাকে ডেকে থামালো। তারপর বললো, একদিন তুমি শিশু ওমর ছিলে, এখন তুমি বয়স্ক ওমর হয়েছ।


কাল তুমি ওমর ছিলে, আজ হয়েছ মুসলমানদের খলীফা। হে ওমর, আল্লাহ তোমার ওপর যে দায়িত্ব অর্পণ করেছেন, সে ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় কর।


মহিলার কথা শুনে ওমর অঝোরে কাঁদতে লাগলেন। খলীফার সঙ্গী মহিলাকে বললো, ওহে আল্লাহর বান্দী, একটু সংযত হয়ে কথা বলুন।


যিনি এই পৃথিবীতে আল্লাহর রাসূলের খলীফা, তাঁকে আপনি কাঁদিয়ে ফেললেন।


ওমর বললেন, “ওহে আমার সহযাত্রী, এ মহিলাকে বলতে দাও।


উনি হচ্ছেন সেই খাওলা বিনতে হাকীম, যার কথা স্বয়ং আল্লাহও শুনেছেন এবং পবিত্র কুরআনে তা বর্ণনাও করেছেন, “হে রাসূল, সেই মহিলার কথা আল্লাহ শুনেছেন যে তোমার সাথে তার স্বামীর ব্যাপারে বাকবিতন্ডা করে এবং আল্লাহর কাছে অভিযোগ করে।


আল্লাহ তোমাদের উভয়ের আলোচনা শ্রবণ করেন।” সুতরাং খাত্তাবের পুত্র ওমরকে তার কথা শুনতেই হবে।”


শিক্ষাঃ শাসকদের কর্তব্য প্রজাদের যাবতীয় অভাব অভিযোগ অনুযোগ ধৈর্য সহকারে শ্রবণ করা ও যথাসাধ্য প্রতিকার করা।


হযরত ওমরের (রা) শাসনে প্রজাদের সম অধিকার!


মিশর বিজয়ী সেনাপতি আমর ইবনুল আস তখন মিশরের গভর্নর।


তাঁর শাসনে মিশরের জনগণ বেশ শান্তিতেই কাটাচ্ছিল।


কিন্তু তাঁর একটা বেয়াড়া ছেলে তাঁর ন্যায়পরায়নার সুনাম প্রায় নষ্ট করতে উদ্যত হয়েছিল।


সে যখনই পথে বেরুত, সবাইকে নিজের চালচলন দ্বারা বুঝিয়ে দিত যে, সে কোনো সাধারণ মানুষ নয়, বরং গভর্নরের ছেলে।


একদিন সে জনৈক মিশরীয় খৃস্টানের ছেলেকে প্রহার করলো।


দরিদ্র মিশরীয় গভর্নরের কাছে তার ছেলের বিরুদ্ধে অভিযোগ করার সাহস পেল না।


তাই নীরবে হজম করলো।


কয়েকদিন পর তার জনৈক প্রতিবেশি মদীনা হতে ফিরে এসে জানালো যে, খলিফা ওমর অত্যন্ত ন্যায়পরায়ণ শাসক।


তিনি জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সকলের সমান অধিকার নিশ্চিত করেন এবং কেউ কারো ওপর যুলুম করেছে জানলে কঠোর শাস্তি দেন।


এ কথা শুনে ঐ মিশরীয় খৃস্টান একটি উটের পিঠে চড়ে দীর্ঘ সতেরো দিন চলার পর মদীনায় খলিফার কাছে পৌছলো এবং গভর্নরের ছেলের বিপক্ষে মোকদ্দমা দায়ের করলো।


হযরত ওমর তৎক্ষণাত হযরত আমর ইবনুল আস এবং তার ছেলেকে মদীনায় ডেকে আনলেন।


অতঃপর বিচার বসলো।


সাক্ষ্য প্রমাণ দ্বারা হযরত আমর ইবনুল আসের(রা) ছেলে দোষী প্রমাণিত হলো।


খলিফা ওমর(রা) অভিযোগকারীর ছেলেকে দেখিয়ে বললেন, সে তোমাকে যেভাবে যে কয়বার প্রহার করেছে তুমিও সেই কয়বার তদ্রুপ প্রহার কর। ছেলেটি যথাযথভাবে প্রতিশোধ নিল।


তারপর খলিফা বললেন, “প্রজারা শাসকের দাস নয়। শাসকরা প্রজাদের সেবক।


প্রজারা ঠিক তেমনি স্বাধীন যেমন তাদের মায়ের পেট থেকে ভূমিষ্ঠ হবার সময় স্বাধীন ছিল।”


উপহার ফিরিয়ে দিলেন উমার ইবনে আবদুল আযীয


এক হাজার দুইশত বাহাত্তর বছর আগের কথা।


ইসলামী দুনিয়ায় তখন উমাইয়া খলিফাদের শাসন।


উমাইয়া বংশের উমার বিন আবদুল আযীয দামেস্কের সিংহাসনে আসীন।


একদিনের ঘটনা।


খলীফা উমার ইবনে আবদুল আযীযের কাছে উপহার এলো।


আপেলের উপহার। আপেলের পক্কতা এবং সুমিষ্ট গন্ধে খলীফা খুবই খুশী হলেন।


আপেল কিছুক্ষণ নেড়ে-চেড়ে তিনি আপেল মালিকের কাছে ফেরত পাঠালেন।


সেখানে উপস্থিত একজন এটা দেখে অনুযোগ করে বললেন, ‘খলীফা, মহানবী (সা) তো এরূপ উপহার গ্রহণ করতেন।


’ উত্তরে খলীফা বললেন, ‘এরূপ উপহার আল্লাহর নবীর কাছে সত্যই উপহার, কিন্তু আমাদের বেলায় ঘুষ।


ঈদে খলীফার ছেলে মেয়ে নতুন জামা-কাপড় পেলনা


দামেস্ক। ইসলামী সাম্রাজ্যের রাজধানী।


খলীফা উমার ইবন আবদুল আযীযের শাসনকাল।


ঈদের মওসুম।


দামেস্কে ঈদের আনন্দ-উৎসবের সাড়া পড়ে গেছে।


আমীর-উমরা, গরীব-মিসকিন সকলেই সাধ্যমত নতুন কাপড়-চোপড় তৈরি করে, রকমারি খাবার বানিয়ে উৎসবের আয়োজনে ব্যস্ত।


আমীরদের ছেলে-মেয়েরা রঙিন পোশাক পড়ে আনন্দ করে বেড়াচ্ছে।


খলীফা অন্দর মহলে বসে আছেন। স্ত্রী ফাতিমা এসে উপস্থিত হলেন।


স্বামীকে বললেন, ‘ঈদ এসে গেল, কিন্তু ছেলেমেয়েদের নতুন পোশাক তো খরিদ করা হলো না।’


খলীফা বললেন, ‘তাই তো, কিন্তু কি করবো।


তুমি যা আশা করছো, তা পূর্ণ করা আমার পক্ষে অসম্ভব।


প্রতিদিন খলীফা হিসেবে আমি যা ভাতা পাই তাতে সংসারের দৈনন্দিন খরচই কুলোয় না, তারপর নতুন পোশাক পড়া, সে অসম্ভব।


ফাতিমা বললেন, ‘তবে আপনি এক সপ্তাহের ভাতা বাবদ


কিছু অর্থ অগ্রিম নিয়ে আমাকে দিন, তাই দিয়ে আমি ছেলেমেয়েদের কাপড় কিনে নেই।’


খলীফা বললেন, ‘তাও সম্ভব নয়।


আমি যে এক সপ্তাহ বেঁচে থাকবো তারই বা নিশ্চয়তা কি।


আর কালই যে জনগণ আমাকে খলীফার পদ থেকে সরিয়ে দেবে না, তাই বা কি করে বলি।


তার চেয়ে এ বিলাস বাসনা অপূর্ণই থেকে যাক- তবু ঋণের দায় থেকে যেন সর্বদা মুক্ত থাকি।


খলীফা ছেলের মুখ থেকে খেজুর কেড়ে নিয়ে রাজকোষে দিলেন"


খলীফা উমার ইবন আবদুল আযীযের কাছে বাইতুলমালের জন্যে কিছু খেজুর এলো।


তাঁর শিশুপুত্র সেখান থেকে একটা খেজুর নিয়ে মুখে পুরে দিল।


তিনি দেখতে পেয়ে সঙ্গে সঙ্গেই তার গাল থেকে খেজুর বের করে বাইতুলমালের ঝুড়িতে রেখে দিলেন।


ছেলে কাঁদতে কাঁদতে মায়ের কাছে চলে গেল।


বাড়ি ফিরে খলীফা স্ত্রীর মলিন মুখ দেখে বললেন, ‘ছেলের মুখ থেকে খেজুর কেড়ে নেবার সময় আমার কলিজা ছিঁড়ে যাচ্ছিল।


কিন্তু কি করবো বল।


বাইতুলমাল জনসাধারণের সম্পত্তি।


এতে জনসাধারণ হিসেবে আমারও অংশ আছে।


কিন্তু ভাগ হবার পূর্বে কেমন করে আমি তা নিতে পারি?’


আরেক দিনের কথা। সানাআ থেকে একজন মহিলা খলীফার কাছে আর্জি নিয়ে এলেন।


সরাসরি খলীফার কাছে না গিয়ে তিনি খলীফার অন্তঃপুরে গেলেন।


বারান্দায় বেগমের কাছে বসে নিজের সুখ-দুঃখের কাহিনী বলতে লাগলেন।


এমন সময় বাইরে থেকে এক ব্যক্তি ভেতরে এলো কুয়ার পানি তুলতে।


পানির বালতি টানতে টানতে লোকটি বারবার বেগমের দিকে চাইলেন।


বিদেশী মহিলার কাছে বড়ই দৃষ্টিকটু লাগল ব্যাপারটা।


তিনি বেগমকে বললেন, গোলামটিকে বাইরে যেতে বলছেন না কেন, দেখছেন না আপনার দিকে কেমন বারবার তাকাচ্ছে।


বেগম একটু মুচকি হাসলেন।


কিছুক্ষণ পর খলীফার ডাকে বিদেশী মহিলাটি তার কাছে গিয়ে হাজির হলেন।


খলীফাকে দেখে তিনি অবাক। এতো সেই ব্যক্তি, জে কুয়ার পানি তুলছিল।


হায় হায়, পোশাকে আশাকে তো তার চাইতে গরীব মনে হচ্ছে খলীফাকে।


খলীফা দিনের পর দিন ডাল খান


বিশাল ইসলামী সাম্রাজ্যের খলীফা উমার বিন আব্দুল আযীয।


তাঁর সাম্রাজ্য তখন পূর্বে ভারত থেকে পশ্চিমে আটলান্টিক মহাসাগর,


দক্ষিনে মধ্য আফ্রিকা থেকে উত্তরে স্পেন ও চীন পর্যন্ত বিস্তৃত।


খলীফা উমার ইবনে আব্দুল আযীযের রাজধানী দামেস্ক তখন শক্তি


ও সমৃদ্ধিতে দুনিয়ার সেরা।সেই খলীফা উমার বিন আব্দুল আযীযের জীবন ছিল দারিদ্রে ভরা।


একদিনের ঘটনা।


সেদিন খলীফার স্ত্রী তাঁর চাকরকে খেতে দিলেন।


আর দিলেন শুধু ডাল।নতুন চাকর খাবার দেখে বিস্মিত হল।


বিস্ময় ভরা চোখে বলল, ‘এই আপনাদের খাদ্য।’


খলীফা পত্নী উত্তরে বললেন, ‘এই সাধারণ খাদ্যই খলীফা দিনের পর দিন গ্রহণ করে যাচ্ছেন।’


ইসলামে রাষ্ট্রের সকল সম্পদের মালিক জনগন,


শাসকেরা সে সম্পদের রক্ষক মাত্র।


খলীফা উমার ইবনে আব্দুল আযীযের কান্না


বিশাল ইসলামী সাম্রাজ্যের শক্তিমান খলীফা উমার ইবনে আব্দুল আযীয।


দামেস্কে তাঁর রাজধানী। রাজধানীতে থাকলেও তাঁর অতন্দ্রচোখ রাজ্যের খুঁটি-নাটি সব বিষয়ের প্রতি।


কিন্তু সব কি তিনি জানতে পারেন?


সব সমস্যার সমাধান কি তিনি দিতে পারেন?


অপারতার ভয় সব সময় তাঁকে অস্থির করে রাখে।


একদিন খলীফা উমার বিন আব্দুল আযীযের স্ত্রী নামাযের পর খলীফাকে অশ্রুসিক্ত অবস্থায় দেখতে পেয়ে ক্রন্দনের কারণ জানতে চাইলেন।


খলীফা বললেন, ‘ওহে ফাতিমা, আমি মুসলমান এবং অন্য ধর্মাবলম্বীদের খাদেম নিযুক্ত হয়েছি।


যে কাঙ্গালগণ অনশনগ্রস্ত, যে পীরিতগন অসহায়, যে বস্ত্রহীনগণ দুর্দশাগ্রস্ত, যে উৎপীড়িতগণ


নিষ্পেষিত, যে অছেনা-অজানাগণ কারারুদ্ধ এবং যে সকল সম্মানিত বয়োজ্যেষ্ঠ


ব্যক্তি তাদের নগণ্য উপার্জন দ্বারা কষ্টে-সৃষ্টে বৃহৎ পরিবারের ভরণ-পোষণ করেন, তাদের


বিষয় এবং পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ও দূরবর্তী প্রদেশে অনুরূপ দুর্দশাগ্রস্ত মানবকুলের বিষয়াদি চিন্তা করছিলাম।


শেষ বিচারের দিন মহাপ্রভু আমার কাছে হিসেব চাইবেন।


সেই জবাবদিহিতে কোন আত্মরক্ষার কৌশলই কাজে লাগবে না।


আমি তা স্মরণ করে কাঁদছিলাম।


জননেতা হয়ে উমার বিন আব্দুল আযীয জনতার কাতারে নেমে এলেন


খলীফা সুলাইমানের মৃত্যুর পর উমার বিন আব্দুল আযীয ইসলামী


বিশ্বের খলীফার দায়িত্ব নিয়ে দামেস্কের সিংহাসনে বসেন।


খলীফা হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত রাজকীয় প্রাচুর্যের মধ্যে তাঁর জীবন কেটেছে।


কিন্তু জনগণের নেতা হবার পর সব প্রাচুর্য তিনি ছুড়ে ফেললেন, নেমে এলেন জনগণের কাতারে।


তিনি খলীফা নির্বাচিত হবার পর খলীফার প্রাসাদের দিকে চলছেন।


রাস্তার দুধারে কাতারে কাতারে দাঁড়ানো আছে সৈন্যের দল।


খলীফা জিজ্ঞেস করলেন, ‘এরা কারা?’ উত্তর এলো, ‘এরা আপনার দেহরক্ষী সৈন্য’।


খলীফা বললেন, ‘প্রয়োজন মতো এদের বাইরে পাঠিয়ে দাও।


আমার দেহরক্ষীর প্রয়েজন নেই।


জনগণের ভালবাসাই আমার প্রতিরক্ষা।’


প্রধান সেনাপতি সশ্রদ্ধ সালাম জানিয়ে তাঁর নির্দেশ পালনের প্রতিশ্রুতি দিলেন।


উমার বিন আব্দুল আযীয প্রাসাদে ঢুকলেন।


দেখলেন, সেখানে ৮শ’ দাস তাঁর অপেক্ষায়ে দণ্ডায়মান।


জিজ্ঞাসা করে জানলেন,এরা তাঁরই সেবার জন্য।


খলীফা প্রধানমন্ত্রীকে বললেন, ‘এদের মুক্ত করে দিন।


আমার সেবার জন্য আমার স্ত্রীই যথেষ্ট।’


প্রধানমন্ত্রী তাঁর হুকুম তামিল করলেন।


বিত্তবান মানুষটি খলীফা হওয়ার পর হলেন দরিদ্র!


খিলাফতের দায়িত্ব নেবার পর লোকেরা উমার বিন আবদুল আযীযকে মুবারকবাদ জানাতে এলো।


তিনি বললেন, ‘তোমরা কাকে মুবারকবাদ দিতে এসেছ, সেই ব্যক্তিকে- যে ধ্বংসের মুখে নিক্ষিপ্ত হয়েছে?


সবচাইতে বিপজ্জনক অবস্থায় পৌঁছে গেছে?’


তাঁকে নতুন খলীফা হবার জন্যে রাজ কোষাগার থেকে বিশেষ খুশবু দেয়া হলো।


কিন্তু তিনি তা গ্রহণ অস্বীকার করে বললেন, ‘খুশবু গ্রহণ করার মত আনন্দের দিন আমার শেষ হয়েছে।


ইসলামী শাসনের অন্তর্ভুক্ত সমগ্র এলাকায় যদি একটি প্রাণীও অনাহারে থাকে বা কোন


একজনের উপরও যদি জুলুম হয়, তাহলে সবার আগে মহাপ্রতাপশালী আল্লাহ উমারকেই পাকড়াও করবেন।’


কবিরা দীর্ঘ প্রশস্তিমূলক কবিতা লিখে দরবারে লাইন দিলেন।


কিন্তু তাঁরা নিরাশ হলেন। খলীফা প্রসংসা শুনতে চান না।


নিজের প্রসংসা শোনার জন্য জনগণের অর্থের একটি কপর্দকও ব্যয় করাকে


তিনি আমানতের খেয়ানত মনে করেন।


তিনি নিজের সম্পত্তির যৎকিঞ্চিত রেখে বাইতুলমালে জমা দিয়ে দিলেন।


কারণ জনগণের অধিকার অন্যায়ভাবে গ্রাস করে তাঁর পূর্বসূরীরা এ


সম্পত্তি হস্তগত করেছিলেন বলে তাঁর মনে সন্দেহ সৃষ্টি হয়েছিল।


নিজের স্ত্রীকেও তিনি আহবান করে বললেন, ‘আমাকে চাও, না তোমার বাপের দেয়া


অন্যায়ভাবে আহরিত তোমার সম্পদগুলো চাও? যদি আমাকে চাও তো এই মুহূর্তে তোমার বাপের


দেয়া সোনাদানা সব সম্পত্তি বাইতুলমালে জমা করে দাও।’


খলীফা সুলাইমানের কন্যা সোনাদানার পরিবর্তে স্বামীকেই পছন্দ করলেন।


খলীফা উমার বিন আব্দুল আযীয রাজপরিবারের লোকদের ভাতাও বন্ধ করে দিলেন।


এইভাবে খলীফা হওয়ার আগে যিনি বিত্তশালী ছিলেন, জাক-জমকে ডুবে


ছিলেন, তিনি ইসলামী সাম্রাজ্যের খলীফা হবার পর সব বিত্ত


ও জাক-জমক পরিত্যাগ করে দারিদ্র গ্রহণ করলেন, নেমে এলেন সাধারণ মানুষের


উমার বিন আবদুল আযীযের দায়িত্বানুভূতি


খিলাফতের দায়িত্ব গ্রহণ করার পর তাঁর নিজের অবস্থা সম্পর্কে উমার বিন আবদুল আযীয


বলেন, “আমি আমার নিজের ব্যাপারে চিন্তা করছি।


আমি তীব্রভাবে অনুভব করছি, গোটা উম্মাহর ছোট বড় প্রতিটি কাজের দায়িত্ব আমার উপর ন্যস্ত।


আমি যখন নিঃস্ব, অসহায়, গরীব, দুঃখী, কয়েদী এবং এরূপ অন্যান্য লোকদের কথা চিন্তা করি,


যারা গোটা সাম্রাজ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে- যাদের দায়িত্বশীল আমি, আমি ভাবি


আল্লাহ তাআলা এদের ব্যাপারে আমাকে জিজ্ঞাসা করবেন।


রাসুলুল্লাহ(সাঃ) এদের সম্পর্কে কঠিন হাশরের ময়দানে জানতে চাইবেন।


তখন আমি কি জবাব দেবো? আল্লাহর সামনে এবং ময়দানে হাশরে শাফায়াতকারীর সামনে


যদি ওজর পেশ করতে না পারি, তবে আমার পরিণাম কি হবে, এই চিন্তায় আমার ঘুম আসে না।


আমার হৃদয় কাঁপছে, অশ্রু বিগলিত হচ্ছে।


দূত উটের পিঠে, খলীফা পায়ে হেঁটে-


৬৩৫ খ্রিস্টাব্দ। তখন কাদেসিয়ায় যুদ্ধ চলছিল।


খলীফা উমার (রাঃ) উদ্বিগ্ন ছিলেন ফলাফল জানার জন্য।


সেদিন মদিনার বাইরে তিনি পায়চারি করছিলেন যুদ্ধক্ষেত্র থেকে কোন দুতের প্রতীক্ষায়।


এমন সময় তিনি দেখলেন অনের দূরে ধুলি উড়িয়ে একজন ঘোড়সওয়ার ছুটে আসছেন মদীনার দিকে।


ঘোড়সওয়ার কাছে আসতেই খোঁজ নিয়ে তিনি জানতে পারলেন কাদেসিয়া থেকে সেনাপতি সা’দ তাকে পাঠিয়েছেন।


খলীফার কাছে যুদ্ধের বিজয়বার্তা তিনি বয়ে এনেছেন।


দূত সাধারণ পোশাক পরিহিত খলীফাকে চিনল না।


খলীফা তার উটের পাশ ঘেঁষে হেঁটে হেঁটে মদীনার দিকে চললেন।


দূত উটের পিঠে আর খলীফা উটের পাশে পায়ে হেঁটে।


সামান্য অহমিকাও খলীফার মধ্যে নেই।


উমার (রাঃ) প্রাসাদ প্রত্যাখ্যান করলেন


অর্ধেক জাহানের পরাক্রমশালী শাসক উমার (রাঃ) গেছেন জেরুজালেমে। পরাজিত রোমান গভর্নর তাঁর হাতে তুলে দিয়েছেন রোমান নগরী। এর আগেই জেরুজালেম নগরীর পতন ঘটে, মুসলিম বাহিনীর হাতে।


রোমান গভর্নর মহা আরম্বরে স্বাগত জানিয়ে উমার (রাঃ) কে নিয়ে গেলেন নগরীর ভেতরে। রোমান গভর্নর সুন্দর সুসজ্জিত বিলাসবহুল প্রাসাদে খলীফার থাকার ব্যবস্থা করলেন। হযরত উমার (রাঃ) সবিনয়ে এই ব্যবস্থা প্রত্যাখ্যান করে বললেন, “আমার ভাইদের সাথে সাধারণ তাঁবুতে থাকাই আমার জন্য বেশি আরামদায়ক হবে। ” ইসলামের শাসক ও নেতারা এমনিই ছিলেন। তাঁরা ছিলেন সাধারনের সাথে একাত্ম। আলাদা প্রাসাদ নয়,সধারনের সাথেই তাঁরা বাস করতেন।


মহানবী (সাঃ) দৌহিত্রী কাপড় পেলেন না উমার (রাঃ) কে মহানবী (সাঃ) উপাধি দিয়েছিলেন ‘আল-ফারুক’। সত্যিই তিনি ছিলেন ‘আল-ফারুক’- সত্য ও মিথ্যার সুস্পষ্ট প্রভেদকারী। বিচারের ক্ষেত্রে, সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে প্রীতি বা অন্যকোন বিবেচনায় সামান্য পক্ষপাতিত্ব তিনি যেমন করতেন না, তেমনি কারো তিলমাত্র অধিকারকেও তিনি উপেক্ষা করতেন না।


একদা হযরত উমার (রাঃ) কর্তৃক মদীনায় মহিলাদের মধ্যে কিছু কাপড় বণ্টন শেষে একখানা উত্তম চাদর অবশিষ্ট রয়ে গেল। তখন তাঁর কাছে উপস্থিত কেউ তাঁকে বললেন, ‘হে আমীরুল মুমিনীন, আপনার কাছে আল্লাহর রাসুলের যে দৌহিত্রী রয়েছেন এ চাদরখানা তাকে দিয়ে দিন।


’দৌহিত্রী বলতে এখানে আলী (রা)-এর কন্যা উম্মে কুলসুমকে বুঝাচ্ছিলেন। উমার (রাঃ) জবাব দিলেন, ‘উম্মে সুলাইমই তা পাওয়ার অধিক উপযুক্ত। অধিক উপযুক্ত হবার কারণ হচ্ছে, সে উহুদ যুদ্ধের দিন আমার জন্য তরবারির খাপ তৈরি করত।’


ওয়াদা পালনের অনুপম নমুনা


মুসলমানরা আদর্শ জাতি।


নীতি-নিষ্ঠতা এই জাতির প্রাণ। ওয়াদা পালন ও শপথ রক্ষা মুসলমানদের অনড় একটা নীতি। এমনকি কোন চুক্তি বা ওয়াদা পরোক্ষ বা প্রকৃত দায়িত্বশীলের পক্ষ থেকে না হলেও তাকে মুসলমানরা সম্মান দেখায়।


খলীফা উমার (রাঃ) এর শাসনকালের একটি ঘটনা।


মুসলিম বাহিনী পারস্যের শুহরিয়াজ নামক একটি শহর অবরোধ করে। নগরটির পতন নিশ্চিত হয়ে ওঠে। সেই সময় মুসলিম বাহিনীর একজন গোলাম শহরবাসীর নামে নিরাপত্তা সনদ লিখে তীরের সাথে বেঁধে শহরে ছুঁড়ে দেয়। পরদিন যখন মুসলিম বাহিনী আক্রমণ চালায়, তখন শহরবাসী দরজা খুলে বেরিয়ে পড়ে এবং বলে, ‘একজন মুসলিম আমাদের নিরাপত্তা দিয়েছে, এখন তোমরা কি জন্য যুদ্ধ করছ?’


নিরাপত্তা সনদটি পড়ে দেখা গেল একজন গোলামের লিখা।


এ সম্পর্কে খলীফা উমারের (রাঃ) মতামত চেয়ে তাঁকে জানানো হল যে, ‘নিরাপত্তা সনদটি গ্রহণযোগ্য কিনা?’


জবাবে খলীফা লিখলেন, ‘সনদটি নিরাপত্তার বৈধ দলিল, শহরবাসীকে নিরাপত্তা দিতে ।


আবু বকরকে (রাঃ) কোনদিন ছাড়িয়ে যেতে পারবোনা


আবু বকর (রা:) তাঁর অতুলনীয় বিশ্বাসপরায়ণতার জন্যে উপাধি পেয়েছিলেন আস সিদ্দিক।


শুধু বিশ্বাস ও আমলেই নয়, দানশীলতার ক্ষেত্রেও তাঁর কোন তুলনা ছিল না।


উমার ইবনে খাত্তাব(রা:) বলেছেন,


তাবুক যুদ্ধের প্রাক্কালে মহানবী(সা:) আমাদের যার যা আছে তা থেকে যুদ্ধ তহবিলে দান করার আহবান জানালেন।


এ আহবান আমি নিজে নিজেকে বললাম, “আমি যদি আবু বকরকে অতিক্রম করতে পারি তাহলে আজই সেই দিন।”


এই চিন্তা করে আমি আমার সম্পদের অর্ধেক মহানবীর(সা:) খেদমতে হাজির করলাম।


আল্লাহর রাসুল জিজ্ঞাসা করলেন, “পরিবারের জন্য তুমি কি রেখেছ ?”


বললাম, “যেই পরিমাণ এনেছি সেই পরিমাণ রেখে এসেছি।”


এরপর আবু বকর তাঁর দান নিয়ে হাজির হলেন।


মহানবী(সা:) ঠিক ঐভাবেই তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, “আবু বকর, পরিবারের জন্য কি অবশিষ্ট আছে?”


আবু বকর জবাব দিলেন, “তাদের জন্য আল্লাহ এবং আল্লাহর রাসুল রয়েছেন।”


আমি আগের মত করেই বললাম “কোন ব্যাপারেই আবু বকরকে কোন দিন ছাড়িয়ে যেতে পারবোনা।


বড় উমারের (রাঃ) ছোট অতীতকে স্মরণ করার ঘটনা


এমন এক সময় ছিল আমার জীবনে, যখন আমি খালাম্মার ছাগল চরাতাম। পরিবর্তে তিনি আমকে দিতেন মুষ্টিতে করে খেজুর। আর আজ সেই আমি এই অবস্থায় উপনীত হয়েছি।”


একদিন মসজিদের মিম্বরে উঠে হযরত উমার (রাঃ) শুধু একথা কয়টি বলেই নেমে পড়লেন। ঐ কথাগুলো এবং এই ধরণের অস্বাভাবিক আচরণ দেখে সবাই অবাক হলেন। আব্দুর রহমান ইবন আউফ বলেই ফেললেন, “আমীরুল মুমিনীন, এর দ্বারা তো আপনি লোকদের সামনে নিজেকে ছোট করলেন।”


হযরত উমার(রা) বললেন, “ঘটনা হলো, একাকীত্বের সময় আমার মনে একথা জেগেছিল যে, তুমি আমীরুল মুমিনীন, তোমার চেয়ে বড় কে হতে পারে। তাই আমি প্রকৃত ঘটনা প্রকাশ করে দিলাম যেন ভবিষ্যতে এমন কথা মনে আর না জাগে।


খলীফার ছেলের বিস্ময়কর বিয়ে


মদিনার এক পল্লী।


তখন রাত। খলীফা উমার(রা:) নাগরিকদের অবস্থা জানার জন্যে মদিনার রাস্তায় ঘুরেছিলেন, হঠাৎ এক বাড়িতে এক বৃদ্ধা ও তাঁর কন্যার কথোপকথন শুনে দাঁড়ালেন। কান পাতলেন তিনি।


বৃদ্ধা মেয়েকে বলছেন, “মা, দুধে পানি মিশিয়ে বিক্রি করলে হয় না? তাহলে আমাদের অবস্থা আরও সচ্ছল হয়।”


কন্যা তার উত্তরে বলল, “তা কি করে হয়, মা।


খলীফার হুকুম, কেউ দুধে পানি মেশাতে পারবেনা।”


বৃদ্ধা বলল, “হোক না খলীফার আদেশ, কেউ তো আর দেখছে না।”


কন্যা প্রতিবাদ করে বলল, “না মা তা হয় না।


প্রত্যেক বিশ্বাসী মুসলমানদের কর্তব্য খলীফার আদেশ মেনে চলা।


খলীফা না দেখতে পান কিন্তু আল্লাহ তো সর্বব্যাপী, তার চোখে ধুলো দেব কি করে?”


খলীফা উমার দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সব কথা শুনলেন।


খলীফা উমার(রা) বাড়িতে ফিরে এলেন। তিনি ঘটনাটা ভুলতে পারলেন না।


ভাবলেন, অজানা ঐ মেয়েটিকে কি পুরস্কার দেয়া যায়। অনেক ভেবে একটা সিদ্ধান্ত নিলেন।


পরদিন দরবারে এসে খলীফা সেই অজানা মেয়েটিকে ডাকলেন।


আহুত হয়ে মা ও মেয়ে ভীতত্রস্ত কম্পিত পদে খলীফার দরবারে এসে উপস্থিত হলো।


তারা উপস্থিত হলে খলীফা তাঁর পুত্রদের ডাকলেন।


পুত্রদের নিকট গত রাতের সমস্ত বিবরণ দিয়ে তিনি তাদের আহবান করে বললেন, “কে রাজি হবে এই কন্যাকে গ্রহণ করতে? এর চেয়ে উপযুক্ত কন্যা আর আমি খুঁজে পাইনি।”


পুত্রদের একজন তৎক্ষণাৎ রাজি হলো। কন্যাও সম্মতি দিল। খলীফার ছেলের সাথে বিয়ে হয়ে গেল মেয়েটির।


গভর্নরের প্রতি উমার (রাঃ)


রাদেশিক গভর্নরের প্রতি উমার বলেনঃ


“হে লোকেরা! আল্লাহর নাফরমানীর কাজে আনুগত্যের দাবী করার অধিকার কারো নেই। এমন ব্যক্তির আনুগত্য করা কিছুতেই বৈধ নয়, যে আল্লাহর নাফরমানীমূলক কাজের নির্দেশ দেয়। একজনকে অপর জনের উপর জুলুম করার কোন সুযোগ আমি দেবো না। কেউ যদি এমনটি করে তবে তার মুখমণ্ডল পদাঘাতে ধুলোমলিন করে ছাড়বো। যাতে করে সে সঠিক পথ অবলম্বনে বাধ্য হয়।


ভালো করে শুনে নাও, আমি তোমাদের যালেম ও জাববার বানিয়ে পাঠাইনি। তোমাদের পাঠিয়েছি জনগণের হেদায়েত লাভের পথপ্রদর্শক হিসাবে। জনগন যাতে তোমাদের দ্বারা সঠিক পথের সন্ধান লাভ করে।


তোমরা মহানুভবতার সাথে জনগণের হক আদায় করবে। তাদের উপর অত্যাচার করবে না। তাঁদের প্রশংসায়ও মুখরিত হবে না, যাতে তোমাদের সাথে তাদের বিশেষ সম্পর্ক গড়ে উঠে। তোমাদের দুয়ার তাদের জন্য বন্ধ রাখবে না……যার ফলে শক্তিমানেরা দুর্বলদের উপর প্রভাব বিস্তারে সুযোগ পায়। নিজেকে তাদের উপর অগ্রাধিকার দিয়ে তাদের প্রতি জুলম করো না।


অজ্ঞতা ও কঠোরতার আচরণ তাদের সাথে করবে না। তাদের দ্বারা কাফিরদের সঙ্গে লড়াই করবে কিন্তু সামর্থ্যের চেয়ে বেশি বোঝা তাদের উপর চাপাবে না, যা তাদের ক্লান্তিতে অবশ করে দেবে…হে মুসলমানগণ, তোমরা সাক্ষী থাকো, আমি গভর্নরদের শুধু এ জন্য পাঠাচ্ছি, যেন তারা শিক্ষা দেয়, গনীমতের মাল বণ্টন করে, ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করে, জনগণের মুকাদ্দামার ফায়সালা করে এবং কোন সমস্যা দেখা দিলে তা যেন আমার সামনে উপস্থাপন করে।”


কিন্তু উমার, আমি যে শান্তির বার্তা বাহক!


হুদাইবিয়ার সন্ধির শর্তগুলো স্থির হয়েছে, কিন্তু স্বাক্ষর তখনও হয়নি। এমন সময় মক্কার একজন মুসলমান পালিয়ে হুদাইবিয়ায় মুসলমানদের কাছে পৌঁছল।


নাম আবু জান্দাল। সে ইসলাম গ্রহণ করায় মক্কাবাসীরা তার উপর অমানুষিক অত্যাচার চালিয়ে আসছে। তার দেহে নির্মম আঘাতের চিহ্নগুলো জ্বলজ্বল করছে। সে মহানবী(সাঃ) এর কাছে আশ্রয়ের আবেদন করলেন।


মহানবীর দরবারে উপস্থিত কুরাইশ নেতা সাহল বলল, ‘সন্ধির শর্ত অনুযায়ী এই লোককে অবিলম্বে মক্কায় ফেরত পাঠাতে হবে।


’ উত্তরে একজন মুসলিম বলল, ‘সন্ধি এখনও স্বাক্ষর হয়নি, সুতরাং এ লোককে ফেরত দিতে এখনই আমরা বাধ্য নই।’


সাহল বলল, ‘যদিও সন্ধি এদিক থেকে অসম্পূর্ণ তবু সন্ধির শর্ত সম্পর্কে আমরা একমত হয়ে গেছি। সুতরাং লোকটিকে অবশ্যই আমাদের হাতে ফেরত দিতে হবে।’


মহানবী(সাঃ) গম্ভীরভাবে বসেছিলেন, অবশেষে তিনি সাহলকে বললেন, ‘ঠিক আছে, তোমার ইচ্ছাই পূর্ণ হবে।’


তারপর তিনি আবু জান্দালের দিকে স্নেহদৃষ্টি তুলে বললেন, ‘আবু জান্দাল, ফিরে যাও, আল্লাহর নামে ধৈর্য ধারণ কর। আল্লাহই তোমার মুক্তির ব্যবস্থা করবেন।’


ক্রন্দনরত আবু জান্দাল মুসলমানদের সামনে দিয়ে মক্কায় চলে গেল। তার কান্না অস্থির করে তুলল মুসলমানদের।


উমার (রা) আর সহ্য করতে পারলেন না। তিনি মহানবীর(সাঃ) সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। অদম্য আবেগে গোটা শরীর কাঁপছিল তাঁর।


বললেন, ‘হে রাসুল, আপনি কি আল্লাহর সত্যিকার রাসুল নন?’


মহানবী(সাঃ) বললেন, ‘নিশ্চয় আমি আল্লাহর রাসুল।’


উমার(রাঃ) বললেন, ‘আমরা হকের উপর আছি, তারা নাহক পথে আছে এটা কি সত্য?’


মহানবী(সাঃ) বললেন, ‘অবশ্যই সত্য।’ উমার(রাঃ) বললেন, ‘তাহলে কেন আপনি অপমানকর সন্ধির অমর্যাদাকে ধরে রাখতে চাইছেন?


আমার আবেদন, সন্ধির শর্ত থেকে আমাদের মুক্তি দিন। তলোয়ারই ফায়সালা করুক।’


মহানবী(সাঃ) হেসে বললেন, কিন্তু উমার, ‘আমি যে শান্তির বার্তাবাহক। ধৈর্য ধর। তুমি যাকে অমর্যাদা বলছ, তার মধ্যেই করুণাময় আল্লাহ এক মহাপুরস্কার লুক্কায়িত রেখেছেন, যা সামনেই দেখতে পাবে’ এই বলে মহানবী(সাঃ) সন্ধিপত্রে তাঁর সীলমোহর লাগালেন এবং তা তুলে দিলেন সাহলের হাতে।


১ম অংশ


উমার ইবনুল খাত্তাব (রা)–


নাম ’উমার, লকব ফারুক এবং কুনিয়াত আবু হাফ্‌স। পিতা খাত্তাব ও মাতা হান্‌তামা।


কুরাইশ বংশের আ’দী গোত্রের লোক। ’উমারের অষ্টম উর্ধ পুরুষ কা’ব নামক ব্যক্তির মাধ্যমে রাসূলুল্লাহর সা. নসবের সাথে তাঁর নসব মিলিত হয়েছে। পিতা খাত্তাব কুরাইশ বংশের একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি।


মাতা ‘হানতামা’ কুরাইশ বংশের বিখ্যাত সেনাপতি হিশাম ইবন মুগীরার কন্যা। ইসলামের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সেনাপতি খালিদ বিন ওয়ালিদ এই মুগীরার পৌত্র। মক্কার ‘জাবালে ’আকিব’- এর পাদদেশে ছিল জাহিলী যুগে বনী ‘আ’দী ইবন কা’বের বসতি।


এখানেই ছিল হযরত উমারের বাসস্থান। ইসলামী যুগে ’উমারের নাম অনুসারে পাহাড়টির নাম হয় ‘জাবালে ’উমার’- ’উমারের পাহাড়। (তাবাকাতে ইবন সা’দ ৩/৬৬) ’উমারের চাচাত ভাই, যায়িদ বিন নুফাইল।


হযরত রাসূলে কারীমের আবির্ভাবের পূর্বে নিজেদের বিচার-বুদ্ধির সাহায্যে মূর্তিপূজা ত্যাগ করে জাহিলী আরবে যাঁরা তাওহীদবাদী হয়েছিলেন, যায়িদ তাঁদেরই একজন।


রাসূলুল্লাহর সা. জন্মের তের বছর পর তাঁর জন্ম। মৃত্যুকালেও তাঁর বয়স হয়েছিল রাসূলুল্লাহর সা. বয়সের সমান ৬৩ বছর।


তবে তাঁর জন্ম ও ইসলাম গ্রহণের সন সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে।


গায়ের রং উজ্জ্বল গৌরবর্ণ, টাক মাথা, গন্ডদেশ মাংসহীন, ঘন দাড়ি, মোঁচের দু’পাশ লম্বা ও পুরু এবং শরীর দীর্ঘাকৃতির।


হাজার মানুষের মধ্যেও তাঁকেই সবার থেকে লম্বা দেখা যেত।


তাঁর জন্ম ও বাল্য সম্বন্ধে তেমন কিছু জানা যায় না। ইবন আসাকির তাঁর তারীখে ’আমর ইবন ’আস রা. হতে একটি বর্ণনা উদ্ধৃত করেছেন।


তাতে জানা যায়, একদিন ’আমর ইবন ’আস কয়েকজন বন্ধু-বান্ধবসহ বসে আছে, এমন সময় হৈ চৈ শুনতে পেলেন।


সংবাদ নিয়ে জানতে পেলেন, খাত্তাবের একটি ছেলে হয়েছে।


এ বর্ণনার ভিত্তিতে মনে হয়, হযরত ’উমারের জন্মের সময় বেশ একটা আনন্দোৎসব অনুষ্ঠিত হয়েছিল।


তাঁর যৌবনের অবস্থাটাও প্রায় অনেকটা অজ্ঞাত।


কে জানতো যে এই সাধারণ একরোখা ধরনের যুবকটি একদিন ‘ফারুকে আযমে’ পরিণত হবেন। কৈশোরে ’উমারের পিতা তাঁকে উটের রাখালী কাজে লাগিয়ে দেন। তিনি মক্কার নিকটবর্তী ‘দাজনান’ নামক স্থানে উট চরাতেন।


তিনি তাঁর খিলাফতকালে একবার এই মাঠ অতিক্রমকালে সঙ্গীদের কাছে বাল্যের স্মৃতিচারণ করেছিলেন এভাবেঃ ‘এমন এক সময় ছিল যখন আমি পশমী জামা পরে এই মাঠে প্রখন রোদে খাত্তাবের উট চরাতাম।


খাত্তাব ছিলেন অত্যন্ত কঠোর ও নীরস ব্যক্তি। ক্লান্ত হয়ে একটু বিশ্রাম নিলে পিতার হাতে নির্মমভাবে প্রহৃত হতাম।


কিন্তু আজ আমার এমন দিন এসেছে যে, এক আল্লাহ ছাড়া আমার উপর কতৃত্ব করার আর কেউ নেই।’ (তাবাকাতঃ ৩/২৬৬–৬৭)


যৌবনের প্রারম্ভেই তিনি তৎকালীন অভিজাত আরবদের অবশ্য-শিক্ষণীয় বিষয়গুলি যথাঃ যুদ্ধবিদ্যা, কুস্তি, বক্তৃতা ও বংশ


তালিকা শিক্ষা প্রভৃতি আয়ত্ত করেন। বংশ তালিকা বা নসবনামা বিদ্যা তিনি লাভ করেন উত্তরাধিকার সূত্রে। তাঁর পিতা ও পিতামহ উভয়ে ছিলেন এ বিদ্যায় বিশেষ পারদর্শী। তিনি ছিলেন তাঁর যুগের একজন শ্রেষ্ঠ কুস্তিগীর। আরবের ‘উকায’ মেলায় তিনি কুস্তি লড়তেন।


আল্লামা যুবইয়ানী বলেছেনঃ ‘উমার ছিলেন এক মস্তবড় পাহলোয়ান।’ তিনি ছিলেন জাহিলী আরবের এক বিখ্যাত ঘোড় সওয়ার।


আল্লামা জাহিয বলেছেনঃ ‘উমার ঘোড়ায় চড়লে মনে হত, ঘোড়ার চামড়ার সাথে তাঁর শরীর মিশে গেছে।’ (আল–বায়ান ওয়াত তাবয়ীন) তাঁর মধ্যে কাব্য প্রতিভাও ছিল। তৎকালীন খ্যাতনামা কবিদের প্রায় সব কবিতাই তাঁর মুখস্থ ছিল।


আরবী কাব্য সমালোচনার বিজ্ঞান ভিত্তিক ধারার প্রতিষ্ঠাতা প্রকৃতপক্ষে তিনিই। ভাষা ও সাহিত্য সম্পর্কে তাঁর মতামতগুলি পাঠ করলে এ বিষয়ে তাঁর যে কতখানি দখল ছিল তা উপলব্ধি করা যায়। বাগ্মিতা ছিল তাঁর সহজাত গুণ।


যৌবনে তিনি কিছু লেখাপড়া শিখেছিলেন।


বালাজুরী লিখেছেনঃ ‘রাসূলে কারীমের সা. নবুওয়াত প্রাপ্তির সময় গোটা কুরাইশ বংশে মাত্র সতের জন লেখা-পড়া জানতেন।


তাদের মধ্যে ’উমার একজন।


ব্যবসা বাণিজ্য ছিল জাহিলী যুগের আরব জাতির সম্মানজনক পেশা।


’উমারও ব্যবসা শুরু করেন এবং তাতে যথেষ্ট উন্নতিও করেন। ব্যবসা উপলক্ষে অনেক দূরদেশে গমন এবং বহু জ্ঞানী-গুণী সমাজের সাথে মেলামেশার সুযোগ লাভ করেন। মাসউদী বলেনঃ ’উমার রা. জাহিলী যুগে সিরিয়া ও ইরাকে ব্যবসা উপলক্ষে ভ্রমণে যেতেন।


ফলে আরব ও আজমের অনেক রাজা-বাদশার সাথে মেলামেশার সুযোগ লাভ করেন।’ শিবলী নু’মানী বলেনঃ ‘জাহিলী যুগেই ’উমারের সুনাম সমগ্র আরবে ছড়িয়ে পড়েছিল। এ কারণে কুরাইশরা সর্বদা তাঁকেই দৌত্যগিরিতে নিয়োগ করতো।


অন্যান্য গোত্রের সাথে কোন বিরোধ সৃষ্টি হলে নিষ্পত্তির জন্য তাঁকেই দূত হিসেবে পাঠানো হত।’ (আল–ফারুকঃ ১৪)


’উমারের ইসলাম গ্রহণ এক চিত্তাকর্ষক ঘটনা। তাঁর চাচাত ভাই যায়িদের কল্যাণে তাঁর বংশে তাওহীদের বাণী একেবারে নতুন ছিল না।


তাঁদের মধ্যে সর্বপ্রথম যায়িদের পুত্র সাঈদ ইসলাম গ্রহণ করেন। সাঈদ আবার ’উমারের বোন ফাতিমাকে বিয়ে করেন। স্বামীর সাথে ফাতিমাও ইসলাম গ্রহণ করেন। ’উমারের বংশের আর এক বিশিষ্ট ব্যক্তি নাঈম ইবন আবদুল্লাহও ইসলাম গ্রহণ করেন।


কিন্তু তখনও পর্যন্ত ’উমার ইসলাম সম্পর্কে কোন খবরই রাখতেন না। সর্বপ্রথম যখন ইসলামের কথা শুনলেন, ক্রোধে জ্বলতে লাগলেন। তাঁর বংশে যাঁরা ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন তাঁদের তিনি পরম শত্রু হয়ে দাঁড়ালেন।


এর মধ্যে জানতে পেলেন, ‘লাবীনা’ নামে তাঁর এক দাসীও ইসলাম গ্রহণ করেছেন।


যাঁদের ওপর তাঁর ক্ষমতা চলতো, নির্মম উৎপীড়ন চালালেন।


এক পর্যায়ে তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, ইসলামের মূল প্রচারক মুহাম্মাদকেই সা. দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিতে হবে। যে কথা সেই কাজ।


আনাস ইবন মালিক থেকে বির্ণত। ‘তরবারি কাঁধে ঝুলিয়ে ’উমার চলেছেন।


পথে বনি যুহরার এক ব্যক্তির (মতান্তরে নাঈম ইবন আবদুল্লাহ) সাথে দেখা। তিনি জিজ্ঞেস করলেনঃ কোন দিকে ’উমার? বললেনঃ মুহাম্মাদের একটা দফারফা করতে। লোকটি বললেন, মুহাম্মাদের সা. দফারফা করে বনি হাশিম ও বনি যুহরার হাত থেকে বাঁচবে কিভাবে? একথা শুনে ’উমার বলে উঠলেনঃ মনে হচ্ছে, তুমিও পৈতৃক ধর্ম ত্যাগ করে বিধর্মী হয়েছে।


লোকটি বললেনঃ ’উমার, একটি বিস্ময়কর খবর শোন, তোমার বোন-ভগ্নিপতি বিধর্মী হয়ে গেছে।


তারা তোমার ধর্ম ত্যাগ করেছে। (আসলে লোকটির উদ্দেশ্য ছিল, ’উমারকে তার লক্ষ্য থেকে অন্য দিকে ঘুরিয়ে দেওয়া।) একথা শুনে রাগে উন্মত্ত হয়ে ’উমার ছুটলেন তাঁর বোন-ভগ্নিপতির বাড়ীর দিকে। বাড়ীর দরজায় ’উমারের রা. করাঘাত পড়লো।


তাঁরা দু’জন তখন খাব্বাব ইবন আল-আরাত-এর কাছে কুরআন শিখছিলেন।


’উমারের আভাস পেয়ে খাব্বাব বাড়ীর অন্য একটি ঘরে আত্মগোপন করলেন। ’উমার বোন-ভগ্নিপতিকে প্রথমেই জিজ্ঞেস করলেনঃ তোমাদের এখানে গুণগুণ আওয়ায শুনছিলেন, তা কিসের? তাঁরা তখন কুরআনের সূরা ত্বাহা পাঠ করছিলেন।


তাঁরা উত্তর দিলেনঃ আমরা নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলছিলাম। ’উমার বললেনঃ সম্ভবতঃ তোমরা দু’জন ধর্মত্যাগী হয়েছো। ভগ্নিপতি বললেনঃ তোমার ধর্ম ছাড়া অন্য কোথাও যদি সত্য থাকে তুমি কি করবে ’উমার? ’উমার তাঁর ভগ্নিপতির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন


এবং দু’পায়ে ভীষণভাবে তাঁকে মাড়াতে লাগলেন। বোন তাঁর স্বামীকে বাঁচাতে এলে ’উমার তাঁকে ধরে এমন মার দিলেন যে, তাঁর মুখ রক্তাক্ত হয়ে গেল। বোন রাগে উত্তেজিত হয়ে বলে উঠলেনঃ সত্য যদি তোমার দ্বীনের বাইরে অন্য কোথাও থেকে থাকে, তাহলে আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন ইলাহ নেই এবং আরো সাক্ষ্য দিচ্ছি, মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল।


২য় অংশ


উমার ইবনুল খাত্তাব (রা)–


এ ঘটনার কিছুদিন আগ থেকে ’উমারের মধ্যে একটা ভাবান্তর সৃষ্টি হয়েছিল।


কুরাইশরা মক্কায় মুসলমানদের ওপর নির্মম অত্যাচার-উৎপীড়ন চালিয়ে একজনকে ফেরাতে পারেনি। মুসলমানরা নীরবে সবকিছু মাথা পেতে নিয়েছে। প্রয়োজনে বাড়ী-ঘর ছেড়েছে, ইসলাম ত্যাগ করেনি। এতে ’উমারের মনে একটা ধাক্কা লেগেছিল।


তিনি একটা দ্বিধা-দ্বন্দ্বের আবর্তে দোল খাচ্ছিলেন। আজ তাঁর প্রিয় সহোদরার চোখ-মুখের রক্ত, তার সত্যের সাক্ষ্য তাঁকে এমন একটি ধাক্কা দিল যে, তাঁর সব দ্বিধা-দ্বন্দ্ব কর্পুরের মত উড়ে গেল। মুহূর্তে হৃদয় তাঁর সত্যের জ্যোতিতে উদ্ভাসিত হয়ে উঠলো।


তিনি পাক-সাফ হয়ে বোনের হাত থেকে সূরা ত্বাহার অংশটুকু নিয়ে পড়তে শুরু করলেন। পড়া শেষ করে বললেনঃ আমাকে তোমরা মুহাম্মাদের সা. কাছে নিয়ে চল। ’উমারের একথা শুনে এতক্ষণে খাব্বাব ঘরের গোপন স্থান থেকে বেরিয়ে এলেন।


বললেনঃ ‘সুসংবাদ ’উমার! বৃহস্পতিবার রাতে রাসূলুল্লাহ সা. তোমার জন্য দুআ করেছিলেন। আমি আশা করি তা কবুল হয়েছে। তিনি বলেছিলেনঃ ‘আল্লাহ, ’উমার ইবনুল খাত্তাব অথবা ’আমর ইবন হিশামের দ্বারা ইসলামকে শক্তিশালী কর।’ খাব্বাব আরো বললেনঃ রাসূল সা. এখন সাফার পাদদেশে ‘দারুল আরকামে’।


’উমার চললেন ‘দারুল আরকামের’ দিকে। হামযা এবং তালহার সাথে আরো কিছু সাহাবী তখন আরকামের বাড়ীর দরজায় পাহারারত। ’উমারকে দেখে তাঁরা সন্ত্রস্ত হয়ে পড়লেন। তবে হামযা সান্ত্বনা দিয়ে বললেনঃ আল্লাহ ’উমারের কল্যাণ চাইলে সে ইসলাম গ্রহণ করে রাসূলের অনুসারী হবে। অন্যথায় তাকে হত্যা করা আমাদের জন্য খুবই সহজ হবে। রাসূল সা. বাড়ীর ভেতরে।


তাঁর উপর তখন ওহী নাযিল হচ্ছে। একটু পরে তিনি বেরিয়ে ’উমারের কাছে এলেন। ’উমারের কাপড় ও তরবারির হাতল মুট করে ধরে বললেনঃ ’উমার, তুমি কি বিরত হবে না?’ …. তারপর দুআ করলেনঃ হে আল্লাহ, ’উমার আমার সামনে, হে আল্লাহ, ’উমারের দ্বারা দ্বীনকে শক্তিশালী কর।’ ’উমার বলে উঠলেনঃ আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি আপনি আল্লাহর রাসূল।


ইসলাম গ্রহণ করেই তিনি আহ্‌বান জানালেনঃ ‘ইয়া রাসূলুল্লাহ, ঘর থেকে বের হয়ে পড়ুন।’ (তাবাকুতুল কুবরা/ইবন সা’দ ৩/২৬৭–৬৯) এটা নবুওয়াতের ষষ্ঠ বছরের ঘটনা।


ইমাম যুহরী বর্ণনা করেনঃ রাসূলুল্লাহ সা. দারুল আরকামে প্রবেশের পর ’উমার ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। তাঁর পূর্বে নারী-পুরুষ সর্বমোট ৪০ অথবা চল্লিশের কিছু বেশী লোক ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। ’উমারের ইসলাম গ্রহণের পর জিবরীল আ. এসে বলেনঃ ‘‘মুহাম্মাদ, ’উমারের ইসলাম গ্রহণে আসমানের অধিবাসীরা উৎফুল্ল হয়েছে।’’ (তাবাকাতঃ ৩/২৬৯)


’উমারের ইসলাম গ্রহণে ইসলামের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হলো। যদিও তখন পর্যন্ত ৪০/৫০ জন লোক ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন এবং তাদের মধ্যে হযরত হামযাও ছিলেন, তথাপি মুসলমানদের পক্ষে কা’বায় গিয়ে নামায পড়া তো দূরের কথা নিজেদেরকে মুসলমান বলে প্রকাশ করাও নিরাপদ ছিল না। হযরত ’উমারের ইসলাম গ্রহণের সাথে সাথে এ অবস্থার পরিবর্তন হলো।


তিনি প্রকাশ্যে ইসলামের ঘোষণা দিলেন এবং অন্যদের সংগে নিয়ে কা’বা ঘরে নামায আদায় শুরু করলেন।


’উমার রা. বলেনঃ আমি ইসলাম গ্রহণের পর সেই রাতেই চিন্তা করলাম, মক্কাবাসীদের মধ্যে রাসূলুল্লাহর সা. সবচেয়ে কট্টর দুশমন কে আছে। আমি নিজে গিয়ে তাকে আমার ইসলাম গ্রহণের কথা জানাবো।


আমি মনে করলাম, আবু জাহলই সবচেয়ে বড় দুশমন। সকাল হতেই আমি তার দরজায় করাঘাত করলাম।


আবু জাহল বেরিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলো, ‘কি মনে করে?’ আমি বললামঃ ‘আপনাকে একথা জানাতে এসেছি যে, আমি আল্লাহ ও তাঁর রাসূল মুহাম্মাদের সা. প্রতি ঈমান এনেছি এবং তাঁর আনীত বিধান ও বাণীকে মেনে নিয়েছি।’


একথা শোনা মাত্র সে আমার মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দিল এবং বললোঃ ‘আল্লাহ তোকে কলংকিত করুক এবং যে খবর নিয়ে তুই এসেছিস তাকেও কলংকিত করুক।’ (সীরাতু ইবন হিশাম)


এভাবে এই প্রথমবারের মত মক্কার পৌত্তলিক শক্তি প্রকাশ্য চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হলো।


সাঈদ ইনবুল মুসায়্যিব বলেনঃ ‘তাঁর ইসলাম গ্রহণের পর মক্কায় ইসলাম প্রকাশ্য রূপ নেয়।’ আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ রা. বলেনঃ ’উমার ইসলাম গ্রহণ করেই কুরাইশদের সাথে বিবাদ আরম্ভ করে দিলেন। শেষ পর্যন্ত তিনি ক’বায় নামায পড়ে ছাড়লেন।


আমরাও সকলে তাঁর সাথে নামায পড়েছিলাম।’ সুহায়িব ইবন সিনান বলেনঃ তাঁর ইসলাম গ্রহণের পর আমরা কা’বার পাশে জটলা করে বসতাম, কা’বার তাওয়াফ করতাম, আমাদের সাথে কেউ রূঢ় ব্যবহার করলে তার প্রতিশোধ নিতাম এবং আমাদের ওপর যে কোন আক্রমণ প্রতিহত করতাম।


(তাবকাতঃ ৩/২৬৯)। তাই রাসূল সা. তাঁকে –‘আল-ফারুক’ উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন।


কারণ, তাঁরই কারণে ইসলাম ও কুফরের মধ্যে প্রকাশ্য বিভেদ সৃষ্টি হয়েছিল। রাসূল সা. বলেছেনঃ ’উমারের জিহ্বা ও অন্তঃকরণে আল্লাহ তাআলা সত্যকে স্থায়ী করে দিয়েছেন। তাই সে ‘ফারুক’। আল্লাহ তাঁর দ্বারা সত্য ও মিথ্যার মধ্যে পার্থক্য করে দিয়েছেন। (তাবাকাতঃ ৩/২৭০)


মক্কায় যাঁরা মুশরিকদের অত্যাচার অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছিলেন, রাসূল সা. তাদেরকে মদীনায় হিজরাতের নির্দেশ দিলেন।


আবু সালামা, আবদুল্লাহ বিন আশহাল, বিলাল ও ’আম্মার বিন ইয়াসিরের মদীনায় হিজরাতের পর বিশজন আত্মীয়-বন্ধুসহ ’উমার মদীনার দিকে পা বাড়ালেন। এ বিশজনের মধ্যে তাঁর ভাই যায়িদ, ভাইয়ের ছেলে সাঈদ ও জামাই খুনাইসও ছিলেন।


মদীনার উপকণ্ঠে কুবা পল্লীতে তিনি রিফায়া’ ইবন আবদুল মুনজিরের বাড়ীতে আশ্রয় নেন।


’উমারের হিজরাত ও অন্যদের হিজরাতের মধ্যে একটা বিশেষ পার্থক্য ছিল। অন্যদের হিজরাত ছিল চুপে চুপে।


সকলের অগোচরে। আর উমারের হিজরাত ছিল প্রকাশ্যে। তার মধ্যে ছিল কুরাইশদের প্রতি চ্যালেঞ্জ ও বিদ্রোহের সূর। মক্কা থেকে মদীনায় যাত্রার পূর্বে তিনি প্রথমে কা’বা তাওয়াফ করলেন। তারপর কুরাইশদের আড্ডায় গিয়ে ঘোষণা করলেন, আমি মদীনায় চলছি।


কেউ যদি তার মাকে পুত্রশোক দিতে চায়, সে যেন এ উপত্যকার অপর প্রান্তে আমার মুখোমুখি হয়। এমন একটি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে তিনি সোজা মদীনার পথ ধরলেন। কিন্তু কেউ এ চ্যালেঞ্জ গ্রহণের দুঃসাহস করলো না। (তারীখুল উম্মাহ আল–ইসলামিয়্যাহঃ খিদরী বেক, ১/১৯৮)


বিভিন্ন বর্ণনার মাধ্যমে জানা যায়, রাসূলুল্লাহ সা. বিভিন্ন সময় বিভিন্ন জনের সাথে ’উমারের দ্বীনী ভ্রাতৃ-সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করে দেন।


আবু বকর সিদ্দীক, ’উয়াইস ইবন সায়িদা, ইতবান ইবন মালিক ও মুয়াজ ইবন আফরা রা. ছিলেন ’উমারের দ্বীনী ভাই। তবে এটা নিশ্চিত যে, মদীনায় হিজরাতের পর বনী সালেমের সরদার ইতবান ইবন মালিকের সাথে তাঁর দ্বীনী ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। (তাবাকাতঃ ৩/২৭২)


হিজরী প্রথম বছর হতে রাসূলে কারীমের সা. ইনতিকাল পর্যন্ত ’উমারের রা. কর্মজীবন প্রকৃতপক্ষে হযরত রাসূলে কারীমের সা. কর্মময় জীবনেরই একটা অংশবিশেষ।


রাসূলকে সা. যত যুদ্ধ করতে হয়েছিল, যত চুক্তি করতে হয়েছিল, কিংবা সময় সময় যত বিধিবিধান প্রবর্তন করতে হয়েছিল এবং ইসলাম প্রচারের জন্য যত পন্থা অবলম্বন করতে হয়েছিল তার এমন একটি ঘটনাও নেই, যা ’উমারের সক্রিয় অংশগ্রহণ ব্যতীত সম্পাদিত হয়েছে। এইজন্য এসব ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ লিখতে গেলে তা ’উমারের রা. জীবনী না হয়ে হযরত রাসূল কারীমের সা. জীবনীতে পরিণত হয়।


তাঁর কর্মবহুল জীবন ছিল রাসূল কারীমের সা. জীবনের সাথে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত।


৩য় অংশ


উমার ইবনুল খাত্তাব (রা) —


হযরত ’উমার বদর, উহুদ, খন্দকসহ সকল যুদ্ধেই রাসূলুল্লাহর সাথে অংশগ্রহণ করেছিলেন।


তাছাড়া আরো বেশ কিছু ‘সারিয়্যা’ (যে-সব ছোট অভিযানে রাসূলুল্লাহ সা. নিজে উপস্থিত হননি)-তে তিনি নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। বদর যুদ্ধের পরামর্শদান ও সৈন্যচালনা হতে আরম্ভ করে প্রতিটি ক্ষেত্রেই তিনি রাসূলে কারীমের সা. সাথে দৃঢ়ভাবে কাজ করেন। বদর যুদ্ধের বন্দীদের সম্পর্কে তাঁর পরামর্শই আল্লাহর পসন্দসই হয়েছিল।


এ যুদ্ধে তাঁর বিশেষ ভূমিকা নিম্নরূপঃ


১. এ যুদ্ধে কুরাইশ বংশের প্রত্যেক শাখা হতে লোক যোগদান করে; কিন্তু বণী আ’দী অর্থাৎ ’উমারের খান্দান হতে একটি লোকও যোগদান করেনি। ’উমারের প্রভাবেই এমনটি হয়েছিল।


২. এ যুদ্ধে ইসলামের বিপক্ষে ’উমারের সাথে তাঁর গোত্র ও চুক্তিবদ্ধ লোকদের থেকে মোট বারো জন লোক যোগদান করেছিল।


৩. এ যুদ্ধে হযরত ’উমার তাঁর আপন মামা আ’সী ইবন হিশামকে নিজ হাতে হত্যা করেন। এ হত্যার মাধ্যমে তিনিই সর্বপ্রথম প্রমাণ করেন, সত্যের পথে আত্মীয় প্রিয়জনের প্রভাব প্রাধান্য লাভ করতে পারে না।


উহুদ যুদ্ধেও হযরত ’উমার রা. ছিলেন একজন অগ্রসৈনিক। যুদ্ধের এক পর্যায়ে মুসলিম সৈন্যরা যখন বিপর্যয়ের সম্মুখীন হলেন এবং রাসূল সা. আহত হয়ে মুষ্টিমেয় কিছু সঙ্গী-সাথীসহ পাহাড়ের এক নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নিলেন, তখন কুরাইশ নেতা আবু সুফিয়ান নিকটবর্তী হয়ে উচ্চস্বরে মুহাম্মাদ সা., আবু বকর রা., ’উমার রা. প্রমুখের নাম ধরে ডেকে জিজ্ঞেস করলো, তোমরা বেঁচে আছ কি?


রাসূলের সা. ইঙ্গিতে কেউই আবু সুফিয়ানের জবাব দিল না। কোন সাড়া না পেয়ে আবু সুফিয়ান ঘোষণা করলোঃ ‘নিশ্চয় তারা সকলে নিহত হয়েছে।’ এ কথায় ’উমারের পৌরুষে আঘাত লাগলো। তিনি স্থির থাকতে পারলেন না।’ বলে উঠলেঃ ‘ওরে আল্লাহর দুশমন! আমরা সবাই জীবিত।’ আবু সুফিয়ান বললো, ‘উ’লু হুবল-হুবলের জয় হোক।’


রাসূলুল্লাহর সা. ইঙ্গিতে ’উমার জবাব দিলেনঃ ‘আল্লাহু আ’লা ও আজাল্লু- আল্লাহ মহান ও সম্মানী।’


খন্দকের যুদ্ধেও ’উমার সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। খন্দকের একটি বিশেষ স্থান রক্ষা করার ভার পড়েছিল ’উমারের ওপর।


আজও সেখানে তাঁর নামে একটি মসজিদ বিদ্যমান থেকে তাঁর সেই স্মৃতির ঘোষণা করছে। এ যুদ্ধে একদিন তিনি প্রতিরক্ষায় এত ব্যস্ত ছিলেন যে, তাঁর আসরের নামায ফউত হওয়ার উপক্রম হয়েছিল। রাসূল সা. তাঁকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেছিলেনঃ ‘ব্যস্ততার কারণে আমিও এখন পর্যন্ত নামায আদায় করতে পারিনি।’ (আল–ফারুকঃ শিবলী নু’মানীঃ ২৫)


হুদাইবিয়ার শপথের পূর্বেই হযরত ’উমার যুদ্ধের প্রস্তুতি আরম্ভ করে দিলেন।


পুত্র আবদুল্লাহকে পাঠালেন কোন এক আনসারীর নিকট থেকে ঘোড়া আনার জন্য।


তিনি এসে খবর দিলেন, ‘লোকেরা রাসূলুল্লাহর সা. হাতে বাইয়াত করছেন।’ ’উমার তখন রণসজ্জায় সজ্জিত। এ অবস্থায় দৌড়ে গিয়ে তিনি রাসূলুল্লাহর সা. হাতে বাইয়াত করেন।


হুদাইবিয়ার সন্ধির শর্তগুলি বাহ্য দৃষ্টিতে মুসলমানদের জন্য অপমানজনক মনে হলো।


’উমার উত্তেজিত হয়ে উঠলেন। প্রথমে আবু বকর, তারপর খোদ রাসূলুল্লাহর সা. নিকট এ সন্ধির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানালেন। রাসূলুল্লাহ সা. বললেনঃ ‘আমি আল্লাহর রাসূল। আল্লাহর নির্দেশ ব্যতীত কোন কাজ আমি করিনে।’ ’উমার শান্ত হলেন। তিনি অনুতপ্ত হলেন। নফল রোযা রেখে, নামায পড়ে, গোলাম আযাদ করে এবং দান খয়রাত করে তিনি গোস্‌তাখীর কাফ্‌ফারা আদায় করলেন।


খাইবারে ইহুদীদের অনেকগুলি সুরক্ষিত দুর্গ ছিলো। কয়েকটি সহজেই জয় হলো। কিন্তু দু’টি কিছুতেই জয় করা গেল না।


রাসূল সা. প্রথম দিন আবু বকর, দ্বিতীয় দিন ’উমারকে পাঠালেন দুর্গ দু’টি জয় করার জন্য। তাঁরা দু’জনই ফিরে এলেন অকৃতকার্য হয়ে। তৃতীয় দিন রাসূল সা. ঘোষণা করলেনঃ ’আগামীকাল আমি এমন এক ব্যক্তির হাতে ঝাণ্ডা দেব, যার হাতে আল্লাহ বিজয় দান করবেন।’ পর দিন সাহাবায়ে কিরাম অস্ত্র সজ্জিত হয়ে রাসূলুল্লাহর সা. দরবারে হাজির। প্রত্যেকেরই অন্তরে এই গৌরব অর্জনের বাসনা।


’উমার বলেনঃ ‘আমি খাইবারে এই ঘটনা ব্যতীত কোনদিনই সেনাপতিত্ব বা সরদারীর জন্য লালায়িত হইনি।’ সে দিনের এ গৌরব ছিনিয়ে নিয়েছিলেন শের-ই-খোদা আলী রা.।


খাইবারের বিজিত ভূমি মুজাহিদদের মধ্যে বণ্টন করা হলো। হযরত ’উমার রা. তাঁর ভাগ্যের অংশটুকু আল্লাহর রাস্তার ওয়াক্‌ফ করে দিলেন। ইসলামের ইতিহাসে এটাই প্রথম ওয়াক্‌ফ। (আল–ফারুকঃ ৩০)


মক্কা বিজয়ের সময় হযরত ’উমার রা. ছায়ার মত রাসূলকে সা. সঙ্গ দেন। ইসলামের মহাশত্রু আবু সুফিয়ান আত্মসমর্পণ করতে এলে ’উমার রাসূলুল্লাহকে সা. অনুরোধ করেনঃ ‘অনুমতি দিন এখনই ওর দফা শেষ করে দিই।’ এদিন মক্কার পুরুষরা রাসূলুল্লাহর সা. হাতে এবং মহিলারা রাসূলুল্লাহর সা. নির্দেশে ’উমারের নিকট বাইয়াত গ্রহণ করছিলেন।


হুনায়িন অভিযানেও হযরত ’উমার অংশগ্রহণ করে বীরত্ব সহকারে লড়াই করেছিলেন। এ যুদ্ধে কাফিরদের তীব্র আক্রমণে বারো হাজার মুসলিম বাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়েছিল। ইবন ইসহাক বলেনঃ মুহাজির ও আনসারদের মাত্র কয়েকজন বীরই এই বিপদকালে রাসূলুল্লাহর সা. সাথে দৃঢ়পদ ছিলেন। তাদের মধ্যে আবু বকর, ’উমার ও আব্বাসের রা. নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।


তাবুক অভিযানের সময় রাসূলুল্লাহর সা. আবেদনে সাড়া দিয়ে হযরত ’উমার রা. তাঁর মোট সম্পদের অর্ধেক রাসূলুল্লাহর সা. হাতে তুলে দেন।


রাসূলুল্লাহর সা. ইনতিকালের খবর শুনে হযরত ’উমার কিছুক্ষণ স্তম্ভিত হয়ে বসে থাকেন। তারপর মসজিদে নববীর সামনে যেয়ে তরবারি কোষমুক্ত করে ঘোষণা করেন, ‘যে বলবে রাসূলুল্লাহ সা. ইনতিকাল করেছেন, আমি তার মাথা দ্বিখণ্ডিত করে ফেলবো।’ এ ঘটনা থেকে রাসূলুল্লাহর সা. প্রতি তাঁর ভক্তি ও ভালোবাসার পরিমাণ সহজেই অনুমান করা যায়।


রাসূলুল্লাহর সা. ইনতিকালের পর ‘সাকীফা বনী সায়েদায়’ দীর্ঘ আলোচনার পর ’উমার খুব দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে হযরত আবু বকরের হাতে খিলাফতের বাইয়াত গ্রহণ করেন। ফলে খলীফা নির্বাচনের মহা সংকট সহজেই কেটে যায়।


খলীফা হযরত আবু বকর যখন বুঝতে পারলেন তাঁর অন্তিম সময় ঘনিয়ে এসেছে, মৃত্যুর পূর্বেই পরবর্তী খলীফা মনোনীত করে যাওয়াকে তিনি কল্যাণকর মনে করলেন। তাঁর দৃষ্টিতে ’উমার রা. ছিলেন খিলাফতের যোগ্যতম ব্যক্তি। তা সত্ত্বেও উঁচু পর্যায়ের সাহাবীদের সাথে এ ব্যাপারে পরামর্শ করা সমীচীন মনে করলেন। তিনি আবদুর রহমান ইবন আউফকে রা. ডেকে বললেন, ’উমার সম্পর্কে আপনার মতামত আমাকে জানান।’ তিনি বললেনঃ ‘তিনি তো যে কোন লোক থেকে উত্তম; কিন্তু তাঁর চরিত্রে


কিছু কঠোরতা আছে।’ আবু বকর বললেনঃ ‘তার কারণ, আমাকে তিনি কোমল দেখেছেন, খিলাফতের দায়িত্ব কাঁধে পড়লে এ কঠোরতা অনেকটা কমে যাবে।’ তারপর আবু বকর অনুরোধ করলেন, তাঁর সাথে আলোচিত বিষয়টি কারো কাছে ফাঁস না করার জন্য।


অতঃপর তিনি ’উসমান ইবন আফ্‌ফানকে ডাকলেন। বললেন, ‘আবু আবদিল্লাহ, ’উমার সম্পর্কে আপনার মতামত আমাকে জানান।’ ’উসমান বললেনঃ আমার থেকে আপনিই তাঁকে বেশী জানেন। আবু বকর বললেনঃ তা সত্ত্বেও আপনার মতামত আমাকে জানান। ’উসমান বললেনঃ তাঁকে আমি যতটুকু জানি, তাতে তাঁর বাইরের থেকে ভেতরটা বেশী ভালো। তাঁর মত দ্বিতীয় আর কেউ আমাদের মধ্যে নেই। আবু বকর রা. তাঁদের দু’জনের মধ্যে আলোচিত বিষয়টি গোপন রাখার অনুরোধ করে তাঁকে বিদায় দিলেন।


এভাবে বিভিন্ন জনের কাছ থেকে মতামত নেওয়া শেষ হলে তিনি উসমান ইবনে আফ্‌ফানকে ডেকে ডিক্‌টেশন দিলেনঃ ‘বিস্‌মিল্লাহির রাহমানির রাহীম। এটা আবু বকর ইবন আবী কুহাফার পক্ষ থেকে মুসলমানদের প্রতি অঙ্গীকার। আম্মা বাদ’- এতটুকু বলার পর তিনি সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলেন। তারপর ’উসমান ইবন আফ্‌ফান নিজেই সংযোজন করেন- ‘আমি তোমাদের জন্য ’উমার ইবনুল খাত্তাবকে খলীফা মনোনীত করলাম এবং এ ব্যাপারে তোমাদের কল্যাণ চেষ্টায় কোন ত্রুটি করি নাই।’ অতঃপর আবু বকর সংজ্ঞা ফিরে পান।


লিখিত অংশটুকু তাঁকে পড়ে শোনান হলো।’ সবটুকু শুনে তিনি ‘আল্লাহু আকবার’ বলে ওঠেন এবং বলেনঃ আমার ভয় হচ্ছিল, আমি সংজ্ঞাহীন অবস্থায় মারা গেলে লোকেরা মতভেদ সৃষ্টি করবে। ’উসমানকে লক্ষ্য করে তিনি আরো বলেনঃ আল্লাহ তা’আলা ইসলাম ও মুসলমানদের পক্ষ থেকে আপনাকে কল্যাণ দান করুন।


তাবারী বলেনঃ অতঃপর আবু বকর লোকদের দিকে তাকালেন। তাঁর স্ত্রী আসমা বিনতু উমাইস তখন তাঁকে ধরে রেখেছিলেন। সমবেত লোকদের তিনি বলেনঃ ‘যে ব্যক্তিকে আমি আপনাদের জন্য মনোনীত করে যাচ্ছি তাঁর প্রতি কি আপনারা সন্তুষ্ট? আল্লাহর কসম, মানুষের মতামত নিতে আমি চেষ্টার ত্রুটি করিনি। আমার কোন নিকট আত্মীয়কে এ পদে বহাল করিনি।


আমি ’উমার ইবনুল খাত্তাবকে আপনাদের খলীফা মনোনীত করেছি। আপনারা তাঁর কথা শুনুন, তাঁর আনুগত্য করুন।’ এভাবে ’উমারের রা. খিলাফত শুরু হয় হিঃ ১৩ সনের ২২ জামাদিউস সানী মুতাবিক ১৩ আগস্ট ৬৩৪ খৃঃ।


হযরত ’উমারের রাষ্ট্র শাসন পদ্ধতি সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা সম্ভব নয়। দশ বছরের স্বল্প সময়ে গোটা বাইজান্টাইন রোম ও পারস্য সাম্রাজ্যের পতন ঘটান। তাঁর যুগে বিভিন্ন অঞ্চলসহ মোট ১০৩৬ টি শহর বিজিত হয়।


ইসলামী হুকুমাতের নিয়মতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠা মূলতঃ তাঁর যুগেই হয়। সরকার বা রাষ্ট্রের সকল শাখা তাঁর যুগেই আত্মপ্রকাশ করে। তাঁর শাসন ও ইনসাফের কথা সারা বিশ্বের মানুষের কাছে কিংবদন্তীর মত ছড়িয়ে আছে।


হযরত ’উমার প্রথম খলীফা যিনি ‘আমীরুল মুমিনীন’ উপাধি লাভ করেন। তিনিই সর্বপ্রথম হিজরী সন প্রবর্তন করেন, তারাবীর নামায জামাআতে পড়ার ব্যবস্থা করেন, জন শাসনের জন্য দুর্রা বা ছড়ি ব্যবহার করেন, মদপানে আশিটি বেত্রাঘাত নির্ধারণ করেন, বহু রাজ্য জয় করেন, নগর পত্তন করেন, সেনাবাহিনীর স্তরভেদ ও বিভিন্ন ব্যাটালিয়ান নির্দিষ্ট করেন, জাতীয় রেজিষ্টার বা নাগরিক তালিকা তৈরী করেন, কাযী নিয়োগ করেন এবং রাষ্ট্রকে বিভিন্ন প্রদেশে বিভক্ত করেন।


’উমার রা. ছিলেন রাসূলুল্লাহর অন্যতম কাতিব। নিজ কন্যা হযরত হাফসাকে রাসূলুল্লাহর সা. সাথে বিয়ে দেন। তিনি রাসূলুল্লাহ সা. ও আবু বকরের রা. মন্ত্রী উপদেষ্টার ভূমিকা পালন করেন। ইসলাম গ্রহণের পূর্বে ও পরে ব্যবসা ছিল তাঁর জীবিকার উপায়। খিলাফতের গুরুদায়িত্ব কাঁধে পড়ার পরও কয়েক বছর পর্যন্ত ব্যবসা চালিয়ে যান। কিন্তু পরে তা অসম্ভব হয়ে দাঁড়ালে হযরত আলী রা. সহ উঁচু পর্যায়ের সাহাবীরা পরামর্শ করে বাইতুল মাল থেকে বাৎসরিক মাত্র আট শ’ দিরহাম ভাতা নির্ধারণ করেন। হিজরী ১৫ সনে বাইতুল মাল থেকে অন্য লোকদের ভাতা নির্ধারিত হলে বিশিষ্ট সাহাবীদের ভাতার সমান তাঁরও ভাতা ধার্য করা হয় পাঁচ হাজার দিরহাম।


বাইতুল মালের অর্থের ব্যাপারে হযরত ’উমারের রা. দৃষ্টিভঙ্গি ছিল ইয়াতিমের অর্থের মত। ইয়াতিমের অভিভাবক যেমন ইয়াতিমের সম্পদ রক্ষণাবেক্ষণ করে। ইয়াতীমের ও নিজের জন্য প্রয়োজন মত খরচ করতে পারে কিন্তু অপচয় করতে পারে না। প্রয়োজন না হলে ইয়াতিমের সম্পদ থেকে হাত গুটিয়ে নিয়ে শুধু হিফাজত করে এবং ইয়াতিম বড় হলে তাকে তার সম্পদ ফিরিয়ে দেয়। বাইতুল মালের প্রতি ’উমারের রা. এ দৃষ্টিভঙ্গিই সর্বদা তাঁর কর্ম ও আচরণে ফুটে উঠেছে।


হযরত ’উমার সব সময় একটি দুর্রা বা ছড়ি হাতে নিয়ে চলতেন। শয়তানও তাঁকে দেখে পালাতো। (তাজকিরাতুল হুফফাজ) তাই বলে তিনি অত্যাচারী ছিলেন না। তিনি ছিলেন কঠোর ন্যায় বিচারক। মানুষকে তিনি হৃদয় দিয়ে ভালোবাসতেন, মানুষও তাঁকে ভালোবাসতো। তাঁর প্রজাপালনের বহু কাহিনী ইতিহাসে পাওয়া যায়।


হযরত ফারুকে আযমের ফজীলাত ও মর্যাদা সম্পর্কে কুরআন ও হাদীসে এত বেশী ইঙ্গিত ও প্রকাশ্য বাণী রয়েছে যে, সংক্ষিপ্ত কোন প্রবন্ধে তা প্রকাশ করা যাবে না। আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সা. নিকট তাঁর স্থান অতি উচ্চে। এজন্য বলা হয়েছে, ’উমারের সব মতের সমর্থনেই সর্বদা কুরআনের আয়াত নাযিল হয়েছে।’ হযরত আলী রা. মন্তব্য করেছেনঃ ‘খাইরুল উম্মাতি বা’দা নাবিয়্যিহা আবু বকর সুম্মা ’উমার- নবীর সা. পর উম্মাতের মধ্যে সর্বোত্তম ব্যক্তি আবু বকর, তারপর ’উমার।’ হযরত আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ বলেনঃ ’উমারের ইসলাম গ্রহণ ইসলামের বিজয়।

তাঁর হিজরাত আল্লাহর সাহায্য এবং তাঁর খিলাফত আল্লাহর রহমত।’ ’উমারের যাবতীয় গুণাবলী লক্ষ্য করেই রাসূলে করীম সা. বলেছিলেনঃ ‘লাও কানা বা’দী নাবিয়্যুন লাকানা ’উমার- আমার পরে কেউ নবী হলে ’উমারই হতো।’ কারণ তাঁর মধ্যে ছিল নবীদের স্বভাব-বৈশিষ্ট্য।

জ্ঞান বিজ্ঞানের চর্চা ও প্রসারের ক্ষেত্রে ’উমারের যথেষ্ট অবদান রয়েছে। তিনি আরবী কবিতা পঠন-পাঠন ও সংরক্ষণের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করেন। আরবী ভাষার বিশুদ্ধতা রক্ষার প্রতি তিনি ছিলেন অত্যন্ত সজাগ; তাঁর সামনে ভাষার ব্যাপারে কেউ ভুল করলে শাসিয়ে দিতেন। বিশুদ্ধভাবে আরবী ভাষা শিক্ষা করাকে তিনি দ্বীনের অঙ্গ বলে বিশ্বাস করতেন। আল্লামা জাহাবী ‘তাজকিরাতুল হুফ্‌ফাজ’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে ’উমার ছিলেন অত্যন্ত কঠোর, একই হাদীস বিভিন্ন সনদের মাধ্যমে বর্ণনার প্রতি তিনি তাকিদ দেন।

প্রখ্যাত সাহাবী মুগীরা ইবন শু’বার রা. অগ্নি উপাসক দাস আবু লু’লু ফিরোজ ফজরের নামাযে দাঁড়ানো অবস্থায় এই মহান খলীফাকে ছুরিকাঘাত করে। আহত হওয়ার তৃতীয় দিনে হিজরী ২৩ সনের ২৭ জিলহজ্জ বুধবার তিনি ইনতিকাল করেন।

মৃত্যুর পূর্বে আলী, উসমান, আবদুর রহমান ইবন আউফ, সা’দ, যুবাইর ও তালহা রা.- এ ছয়জন বিশিষ্ট সাহাবীর ওপর তাদের মধ্য থেকে কোন একজনকে খলীফা নির্বাচনের দায়িত্ব অর্পণ করে যান। হযরত সুহায়িব রা. জানাযার নামায পড়ান।

রওজায়ে নববীর মধ্যে হযরত সিদ্দীকে আকবরের পাশে তাঁকে দাফন করা হয়।

মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৬৩ বছর।

তাঁর খিলাফতকাল দশ বছর ছয় মাস চার দিন।


আপনি আচরি ধর্ম অপরে শিখাও


হযরত উমার (রা) তখন খলীফা। খলীফা উমার (রা) এর বাড়ী থেকে বেশ কিছু দূরে একটি পনির কুপ।

খলীফা উমার (রা) এর বাড়ী থেবে বেশ কিছু দূরে একটি পানির কুপ। খলীফার সাক্ষাতপ্রার্থী একজন লোক দেখলেন, খলীফা কূপ থেকে পানি তুলঠেন।

শুধু পানি তোলা নয় আগন্তুক বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করলেন, পৃথিবীর শাসক উমাপর, পারস্য ও রোম সাম্রাজ্য পদাতনকারী উমার (রা) সেই পানি ভরা কলসি কাঁধে তুলে নিলেন।


আগন্তুক আর স্থির থাকতে পারলেন না। তিতিন দ্রুত খলীফার নিকটে গেলেন।

একজন অপরিচিত লোককে দেখে হযরত উমার (রা) বললেন, “ভাই, আপনার কি কোন কথা আছে, বলবেন আমাকে?”

লোকটি বললেন, “হে আমীরুল মুমিনীন, যদি কলসটি দয়া করে আমার কাঁধে দিতেন।”

হযরত উমার (রা) যেতেহ যেতেই বললেন, “আমার ছেলে-মেয়ের খাদ্য পানীয় সংগ্রহের মাধ্যমে পুণ্য সঞ্চয় করা কি আমার উচিত নয়?

আচ্ছা, এ ছাড়া কি আপনি আর কিছু বলবেন?”

আগন্তুক লোকটি বললেন, “আপনার এই অবস্থায় বলার মত কোন কথা আমার মনে আসছেনা। আগে বাড়ী চলুন। তারপর বলব। আমি আপনাকে অপেক্ষা করতে বলব, আপনি কাঁধে বোঝা নিয়ে আমার কথা শুনবেন, এটা হতে পারে না।”

আগন্তুকের কথা শুনে হযরত উমার থমকে দাঁড়ালেন। বোথ হয় ভাবলেন, ‘আমি আমার নিজের কাজ করছি, এ কাজের অজুহাতে আগন্তুককে দাঁড় করিয়ে রাখা ঠিক হবে না।’

তিনি কাঁধ থেক কলসি নামিয়ে জানুর উপর রাখলেন। তারপর বললেন, “বলুন, আপনার কথা।”

আগন্তুক ভীষণ বিব্রত বোধ করলেন। তার কথা শুনার জন্য আমীরাল মুমিনীন এ ভাবে কষ্ট করবেন। কলসটি মাটিতে নামিয়ে রাখলে তবু কিচুটা কষ্টের লাঘব হয় তাঁর।

তিনি খলীফাকে নিবেদান করলেন, “জানুর উপর কলস রেখে কথা শুনতে আপনার কষ্ট হবে। কলসটি দয়া করে মাটিতে রাখুন।”

খলীফা বললেন, “তা কি করে হয় ভাই? কলসির তলা ভিজা এ জমিটি আমার নয়।ভিজা কলসির তলায় লেগে অন্যের জমি আমার বাড়িতে চলে গেলে, আকি কি জওয়াবদিহি করব?”

লোকটি বলল, “আমার জিজ্ঞাসার জবাব আমি পেয়ে গেছি, আপনি দয়া করে যান।”

উমার (রা) বললেন, “বুঝলাম না, বুঝিয়ে বলুন।”


লোকটি বলল, “ইয়া আমীরুল মুমিনীন, আমি জিজ্ঞাসা করতে এসেছিলাম বর্তমান জরীপে অন্যের জমির কতকাংশ আমার জমির সাথে উঠে এসেছে।

তা আমার জন্য হালাল কিনা?


হযরত উমারের (রা) ভাতা বৃদ্ধির চেষ্টা

উমারের (রা) খিলাফত। খীলফা হওয়ারা পূর্বে উমার ব্যবসা করে পরিবার চালাতেন।

যখন খলীফা নিযুক্ত হলেন, তখন জনসাধারণের ধনাগার (বাইতুলমাল) থেকে অতি সাধারণভাবে জীবন ধাণের উপযুক্ত অর্থ তাঁকে ও তাঁর পরিবারের জন্য দেয়া হলো। বছরে মাত্র দু‘প্রস্থ পোশাক।

পারস্য ও রোম সাম্রাজ্যের শক্তি যাঁর কাকছে নত, সেই দোর্দন্ড প্রতাপ খলীফা উমার সামান্য অর্থ পান জীবনধারণের জন্য।


হযরত আলী, উসমান ও তালহা ঠিক করলেন খলীফার এ মাসোহারা যথোপযুক্ত নয়, আরও কিছু অর্থ বাড়িয়ে দেয়া হোক।

কিন্তু কে এই প্রস্তাপব খলীফা উমারের কাছে পেশ করবে। অবশেষে উমারের কন্যা ও রাসূলের (রা) স্ত্রী হাফসাকে (রা) তাঁর কাছে এই প্রস্তাব উত্থাপন করার জন্য অনুরোধ করা হলো।

হাফসা (রা) পিতার নিকট এই প্রস্তাব তুলতেই খলীফা উমার তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলেন। রুক্ষস্বরে তিনি প্রশ্ন করলেন, “কারা এই প্রস্তাব করেছে?” হাফসা নিরুত্তর।

পিতাকে তিনি কি উত্তর দেবেন? সাহস হলোনা। খলীফা বললেন, “যদি জানতাম কারা এই প্রস্তাব তোমার মারফতে পাঠিয়েছে। তবে তাদের পিটিয়ে আমি নীল করে দিতনি।

বেটি, তুমিতো জান, কি পোশাক রাসূল (সা) পরিধান করতেন, কিরূপ খাদ্য তিনি গ্রহণ করতেন, কি শয্যায় তিনি শয়ন করতেন। বলত, আমার পোশাক, আমার খাদ্য, আমার শয্যা কি তার চাইতে নিকৃষ্ট?”

হাফসা উত্তর দিলেন, “না”।

খলীফা বললেন, “তবে যারা এই প্রস্তাব করে পাঠিয়েছে, তাদের বলো, আমাদের নবী জীবনের যে আদর্শ স্থাপন করে গেছেন তাত থেকে আমি এক চুলও বিচ্যুত হবে না।” সে আগুন ছড়িয়ে গেল সাবধানে—

সহজ অনাড়ম্বর ও নিঃস্বার্থ জীবন যাপন সত্যিকাকর মানুষের আদর্শ——সংযত ও সুনিয়ন্ত্রিত যার জীবন নয়, সে কি করে শহীদের রক্তাক্ষরে লেখা সত্যের জীবনকে গ্রহণ করবে?

খলীফা উমারও এক দিন আততায়ীর হস্তে নিহত হন। সত্যের পথে, ন্যায়ের পথে চলেছিলেন এই তাঁর অপরাধ।

খলীফা উমার শহীদ হয়েছেন কবে, কিন্তু সত্যের নির্ভীক সাধক শহীদ উমার আজও বেঁচে আছেন দেশ ও জাতির দিগদর্শরূপে।


হযরত উমারের (রা) ছেলের কান্না


মক্তব থেকে এসে খলীফা উমারের ছেলে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে।

উমার (রা) তাকে টেনে জিজ্ঞাসা করলেন, কাঁদছ কেন বৎস?

ছেলে উত্তর দিল, “সবাই আমাকে টিটকারী দেয়।” বলে, “দেখনা জামার ছিরি, চৌদ্দ জায়গায় তালি।

বাপ নাকি আবার মুসলিম জাহানের শাসনকর্তা।” বলে ছেলেটি তার কান্নার মাত্রা আরো বাড়িয়ে দিল।

ছেলে কথা শুনে উমার (রা) ভাবলেন কিছুক্ষন।

তারপর বাইতুল মা’লের কোষাধ্যক্ষকে লিখে পাঠালেন, “আমাকে আগামী মাসের ভাতা থেকে চার দিরহাম ধার দেবেন।”

উত্তরে কোষাধ্যক্ষ তাঁকে লিখে জানালেন, “আপনি ধার নিতে পারেন।

কিন্তু কাল যদি আপনি মারা যান তাহলেকে আপনার ধার শোধবে?”

উমার (রা) ছেলের গা-মাথা নেড়ে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, “যাও বাবা, যাআছে তা পরেই মক্তবে যাবে।

আমাদের তোআর অনেক টাকা পয়সা নেই।

আমি খলীফা সত্য, কিন্তু ধন সম্পদ তো সবই জন সাধারণের।

সা‘দের প্রাসাদে আগুন

সেনাপতি সা’দ। মুসলিম বাহিনীর অধিনায়ক সা’দ পারস্য জয় করেছেন।


বিজয়ের পর হযরত উমার তাঁকে কুফার শাসনকর্তা নিযুক্ত করলেন।

সেনাপতি সা’দ তাঁর বিজয় অভিযান কালে পারস্য সম্রাটের বিলাসব্যসন ও আরাম আয়েশের অফুরান নজীর দেখেছেন।


কুফা নগরী সাজাবার সময় বোধ হয় তাঁর সেসব কথা মনে পড়েছিল।

তিনি নিজের জন্যও তাই সেখানে একটি প্রাসাদ তৈরী করলেন এবং সম্রাট খসরুর প্রাসাদের একটি তোরণ এনে তাঁর প্রাসাদে সংযুক্ত করলেন। বোধ হয় বিজেতা সা‘দের মনে আয়েশের কিঞ্চিত আমেজ এসে বাসা বেঁধেছিল।


এনিষ্কলুষ ভোগ তাঁর কাছে কোন খারাপ বিষয় বলেও বোধ হয়নি।

কিন্তু খবরটা খলীফা উমারের কাছে পৌঁছতেই তিনি বারুদের মত জ্বলে উঠলেন।

সেনাপতি সা’দের মতি বিভ্রম ঘটেছে কিনা তিনি ভেবে পেলেন না। হযরত উমার (রা) ত্বরিত একজন দূতকে সা‘দের নামে একটি চিঠি দিয়ে বললেন, “শোন, পৌঁছেই তুমি সা‘দের প্রাসাদে আগুন ধরিয়ে দেবে।


সা’দ তোমাকে এর কারণ জিজ্ঞেস করলেই তাকে এ চিঠিখানা দেবে।” দূত ছুটল কুফার দিকে। হযরত উমারের যা নির্দেশ ছিল, তাই করল সে। সা’দের প্রাসাদে আগুণ ধরিয়ে দিলো।

স্তম্ভিত সা’দ খলীফার দূতের এ কান্ড দেখে তাকে এর কারণ জিজ্ঞেস করলেন। দূত বিনা বাক্য ব্যয়ে খলীফার চিঠি তাঁর হাতে তুলে দিল। সা’দ চিঠিটা তাঁর চোখের সামনে মেলে ধরলেন।


তাতে লিখা ছিলঃ “শুনতে পেলাম, নিজের আরাম-আয়েশের হন্য থমরুর প্রাসাদের মত তুমি এক প্রাসাদ গড়েছো।

শুনেছি, খসরুর প্রাসাদের একটি কবাটও এনে তোমার প্রাসাদে লাগিয়েছ। দগারোয়ান, সিপাইও রেখেছ। এতে প্রজাদের অভাব অভিযোগ জানাতে অসুবিধা হবে। তা বোধ হয় তুমি নিশ্চয় ভাবনি। নবীর পথ পরিত্যাগ করে খসরুর পথ ধরেছো।

ভুলোনা, প্রাসাদে বাস করেও খসরুদের দেহ কবরে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে আর নবী সামান্য কুটিরে বাস করেও বর্বোচ্চ জান্নাতে উন্নীত হয়েছেন।

মাসলামকে তোমার প্রাসাদ পুড়িয়ে ফেলবার জন্য পাঠালাম। বাস করার জন্য একটি কুটির এবং একটি খাজাঞ্চি খানাই যথেষ্ট।”

সা’দ নত মস্তকে, অশ্রুসিক্ত নয়নে খলীফার নির্দেশ মেনে নিলেন।


আমীরুল মুমিনীন কৈফিয়ত দিলেন


শুক্রবার। জুমার নামায। ইমামের আসনে হযরত উমার।

খোতবা দানের জন্য তিনি মিম্বারে দাঁড়িয়েছেন। চারদিকে নিঃশব্দ নীরবতা। সকলের চোখ খলীফা উমারের দিকে। হঠাৎ মসজিদের অভ্যন্তর থেকে একজন লোক উঠে দাঁড়াল। সে বলল, “উপস্থিত ভ্রাতৃগণ!

গতকাল আমরা বাইতুল মাল থেকে এক টুকরা করে কাপড় পেয়েছি। কিন্তু খলীফা আজ যে নতুন জামাটি গায়ে দিয়েছেন, তা তৈরী করতে অন্ততঃ তিন টুকরা কাপড়ের প্রয়োজন।

তিনি আমাদের খলীফা, এই জন্যই কি আরও টুকরা কাপড় বেশী নিয়েছেন?”

খলীফার পুত্র দাঁড়িয়ে বললেন, “আব্বাজানের পুরোনো জামাখানা গায়ে দেয়ার অযোগ্য হয়ে গেছে। এজন্য আমার অংশের টুকরাটি আব্বাজানকে দিয়েছি।”

এরপর খলীফার চাকর উঠে বলল, “আমার টুকরাটিও অনেক সাধা-সাধি করে খলীফাকে দিয়েছি। তাই দিয়েই জামা তৈরী হয়েছে।”

এই বার খলীফা সেই জিজ্ঞাসাকারী ব্যক্তিকে কৃত্রিম রোষে বললেন, “দেখুন সাহেব, কার বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন?”

লোকটি বলল, “নিশ্চয় আমি বর্তমান বিশ্বের শ্রেষ্ঠ শাসক আমীরুল মুমিনীন সম্বন্ধে অভিযোগ করেছি।”

খলীফা পুনরায় বললেন, “আচ্ছা সত্যই যদি আমি এমন কাজ করতাম, আপনি কি করতেন।?”

খলীফার কথা শেষ হবার সংগে সংগেই লোকটি সরোষে বলল, “তরবারি দিয়ে আপনার মস্তক দুইখন্ড করে ফেলতাম।”

লোকটির এ ধৃষ্টতা দর্শনে জামাতের সকলেরই মুখ ভয়ে শুকিয়ে গেল।

কিন্তু খলীফা হাত উঠিয়ে হাসি ও খুশী ভরা গদগদ কণ্ঠে মুনাজাক করলেন, “ইয়া আল্লাহ, আপনার শুকরিয়া যে, আপনার প্রিয় নবীর বিধান রক্ষার্থে নামাযের জামাতে বসেও এমন বিশ্ব ভীতি উমারকে তলোয়ার দেখাবার মুসলমানের অভাব নেই।”


শুক্রবার। জামআর নামায পড়তে খলীফা মসজিদে গেছেন।

সামনে পিছনে তালি দেয়া একটি কামিছ তাঁর গায়ে। একজন অনুযোগ করে বলল, “ আল্লাহ আপনাকে প্রচুর দিয়েছেন, আপনি অন্ততঃ একটু ভালভাবে পোষাক পরিধান করুন।”

খলীফা কিছুক্ষণ নীরব থেকে বললেন, “প্রাচুর্যের মধ্যে সংযম পালনও শক্তিমানের পক্ষে ক্ষমা প্রদর্শন অতীব প্রশংসনীয়।”

উৎসর্গীকৃত জীবন যাদের, আড়ম্বর- বিলাস, সুখাদ্য গ্রহণ, পোশাক পরিচ্ছদ প্রভৃতির দিকে লক্ষ্য দেয়ার সময় তাদের কোথায়?


আইনের চোখে সবাই সমান

হজ্জ করবার সময় ভিড়ের মধ্যে আরবের পার্শ্ববর্তী এক রাজার চাদর এক দাসের পায়ে জড়িয়ে যায়।

বিরক্ত ও ক্রুদ্ধ হয়ে রাজা জাবালা সেই দাসের গালে চড় বসিয়ে দিলেন। লোকটি খলীফা উমর (রা)-এর নিকট সুবিচার প্রার্থনা করে নালিশ করে। জাবালাকে তৎক্ষনাৎ ডেকে পাঠানো হলো।

অভিযোগ সত্য কিনা জিজ্ঞাসা করায় জাবালা রূঢ় ভাষায় উত্তর দিলেন, “অভিযোগ সত্য। এই লোকটি আমার চাদর মাড়িয়ে যায় কাবা ঘরের চত্বরে।” “কিন্তু কাজটি তার ইচ্ছাকৃত নয়, ঘটনাক্রমে হয়ে গেছে”- রুক্ষ স্বরে বাধা দিয়ে বললেন খলীফা।

উদ্ধতভাবে জাবালা বললেন, “তাতে কিছু আসে যায় না- এ মাসটা যদি পবিত্র হজ্জের মাস না হতো তবে আমি লোকটিকে মেরেই ফেলতাম।” জাবালা ছিলেন ইসলামী সাম্রাজ্যের একজন শক্তিশালী মিত্র ও খলীফার ব্যক্তিগত বন্ধু।

খলীফা কিছুক্ষণ চিন্তা করলেন, তারপর অতি শান্ত ও দৃঢ় স্বরে বললেন, “জাবালা, তুমি তোমার দোষ স্বীকার করেছ। ফরিয়াদী যদি তোমাকে ক্ষমা না করে তবে আ পরিবর্তে সে তোমাকে চড় লাগাবে।”

গর্বিত সুরে উত্তর দিলেন জাবালা, “কিন্তু আমি যে রাজা আর ও যে একজন দাস।” উত্তরে উমর (রা) বললেন, “তোমরা দু’জনেই মুসলমান এবং আল্লাহর চোখে দু’জনেই সমান।”

গর্বিত রাজার অহংকার চূর্ণ হয়ে গেল। গর্ব, অহংকার, মদমত্ততা মানুষের ধর্ম নয়। সে নির্ভীক, নির্বিকার ও নির্মম। কিন্তু

শান্ত, সংযত ও সুন্দর সে।

সত্যের বাণী যারা অন্তর দিয়ে গ্রহণ করেছেন, মানব গোষ্ঠীর প্রতি তাঁদের দায়িত্ববোধ অসীম। মানুষের সেবা, সৃষ্ট জীবের সেবা করেই তাঁরা এই দায়িত্ব থেকে মুক্ত হন। আল্লাহ যার হাতে নেতৃত্ব দেন, তিনি আসলে জনসেবক।

অসীম বেদনাবোধ, বিপুল দায়িত্বভার তাঁর। এই বেদনা ও দায়িত্বভারেই খলীফা উমর (রা) অস্থির থাকতেন।

সবাই ঘুমিয়ে পড়লেও নিঝুমনিশীতে স্বীয় দায়িত্বের কথা স্মরণ করে উমর (রা) অঝোরে কাঁদতেন।


উবাদা ইবনে সামিতের শপথ রক্ষা

খলীফা উমার (লা) শাসনকাল। মুয়াবিয়া তখন সিরিয়ার শাসনকর্তা।

মদীনার খাযরাজ গোত্রের হযরত উবাদা ইবন সামিত গেলেন সিরিয়ায়। বাইয়াতে রিদওয়ানে শরীক আনসার উবাদা ইবন সামিত সত্য প্রকাশের ক্ষেত্রে দুনিয়ার কোন মানুষকেই ভয় করেন না।

সিরিয়ায় ব্যবসা ও শাসনকার্যে কতকগুলো অনিয়ম দেখে তিনি ক্রোধে জ্বলে উঠলেন।


দামেশকের মসজিদ। সিরিয়ার গভর্ণর মুয়াবিয়াও উপস্থিত মসজিদে। নামাযের জামাত শেষে হযরত উবাদা ইবন সামিত উঠে দাঁড়িয়ে মহানবীর (রা) একটি হাদীস উদ্ধৃত করে তীব্র ভাষায় অভিযুক্ত করলেন হযরত মুয়াবিয়াকে।

চারদিকে হৈচৈ পড়ে গেল। মুয়াবিয়ার পক্ষে তাঁর মুখ বন্ধ করা সম্ভব হলো না। একা উবাদা ইবনে সামিত গোটা সিরিয়াকে যেন নাড়া দিলেন। ইতোমধ্যে হযরত উমার (রা) ইন্তিকাল করেছেন।


অবশেষে উপায়ন্তর না দেখে হযরত মুয়াবিয়া তৃতীয় খলীফা হযরত উসমানকে (লা) লিখলেন, “হয় আপনি উবাদাকে মদীনায় ডেকে নিন, নতুবা আমিই সিরিয়া ত্যাগ করব।

গোটা সিরিয়াকে উবাদা বিদ্রোহী করে তুলেছে।”


উবাদাকে মদীনায় ফিরিয়ে আনা হলো। মদীনায় এসে হযরত উবাদা সোজা গিয়ে হযরত উসমানের (রা) বাড়ীতে উঠলেন। হযরত উসমান (রা) ঘরে বসে, ঘরের বাইরে প্রচুর লোক। তিনি ঘরে ঢুকে ঘরের এক কোণে বসে পড়লেন।

হযরত উসমান (রা) জিজ্ঞাসা করলেন, “কি খবর।” হযরত উসমানের কথার উত্তরে উবাদা উঠে দাঁড়ালেন।


স্পষ্টবাদী, নির্ভীক উবাদা বললেন, “স্বয়ং মহানবীর উক্তি পরবর্তী কালের শাসকরা অসত্যকে সত্যে এবং সত্যকে অসত্যে পরিণত করবে।

কিন্তু পাপের অনুকরণ বৈধ নয়, তোমরা কখনও অন্যায় করো না।”

হযরত আবু হুরাইরা (রা) কিছু বলতে যাচ্ছিলেন।

হযরত উবাদা তাঁকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, “যখন আমরা মহানবীর (সা) হাতে বাইয়াত করি, তখন তোমরা ছিলে না, কাজেই তোমরা অনর্থক কথার মাঝখানে বাধা দাও কেন? আমরা সেদিন মহানবীর (সা) হাতে বাইয়াত করি, তখন তোমরা ছিলে না, কাজেই তোমরা অনর্থক কথার মাঝখানে বাধা দাও কেন?

আমরা সেদিন মহানবীর (রা) কাছে শপথ করেছিঃ সুস্থতা ও অসুস্থতা সব অবস্থায়ই আপনাকে মেনে চলব, প্রাচুর্য় ও অর্থ সংকট সব অবস্থায়ই আপনাকে অর্থ সাহায্য করব, ভাল কথা অন্যের কাছে পৌঁছাব, অন্যায় থেকে সবাইকে বারণ করব।

সত্য কথা বলতে কাকেও ভয় করবো না।”

হযরত উবাদা এসব শপথের প্রতিটি অক্ষর পালন করে গেছেন জীবনের শেষ পর্যন্ত।

তাঁর জীবনের অন্তিম মুহূর্ত।

তাঁকে কিচু অসিয়ত করতে বলা হলে তিনি বললেন, “যত হাদীস প্রয়োজনীয় ছিল, তোমাদেরকে পৌঁছে দিয়েছি, আর একটি হাদীষ ছিল, বলছি শুন।” হাদীস বর্ণানা শেষ হবার সাথে সাথেই হযরত উবাদা ইবন সামিত ইন্তিকাল করলেন।

কিছু অভাব অভিযোগের কথা নিয়ে এসেছিলাম কিন্তু এখন দেখি খলীফা সুলাইমান তাঁর মৃত্যুর পূর্বে গাসবা ইবন সাদ ইবন আসকে বিশ হাজার দীনার দান করে একটি দানপত্র লিখে দিয়ে ছিলেন।

কিন্তু টাকাটা গাসবার হাতে যাওয়ার পূর্বেই খলীফা সুলাইমানের মৃত্যু ঘটে।


খলীফা সুলাইমানের মৃত্যুর পর উমার ইবন আবদুল আযিয খলীফা হন। তাঁর খলীফা পদ সমাসীন হবার কয়েকদিন পর গাসবা তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করে বলল, “খলীফা সুলাইমান আমাকে কিছু অর্থ দান করার নির্দেশ দিয়েছিলেন।

সে নির্দেশ কোষাগারে এসে পৌঁছেছে। আপনি আমার বন্ধুলোক, আশা করি আমার জন্য খলীফা সুলাইমানের সে নির্দেশ আনন্দের সাথেই কার্যকর করবেন।”


সত্যিই গাসবা উমার ইবনুল আযিযের বন্ধু ছিল।

তিনি সহাস্যে বললেন, “কত টাকা?” গাসবা উত্তর দিল “বিশ হাজার দিনার।” শুনে খলীফা উমাররে ভ্রুদ্বয় কুঞ্চিত হয়ে উঠলো।

তিন বললেন, “সর্ব সাধারনের সম্পত্তি থেকে কোন একজনকে বিনা করণে এত টাকা দেয়া কিভাবে সম্ভব? আল্লাহর কসম, আমর পক্ষে এটা কিছুতেই সম্ভব নয়।”

শুনে গাসবা খুবই রেগে গেল। কিন্তু রাগ চেপে সে চিন্তা করতে লাগল, কিভাবে খলীফাকে উচিত জবাব দেয়া যায়, কি করে তাকে জব্দ করা যায়।

সে উমার উবন আব্দুল আযিযকে খোঁচা দেয়ার একটি পথ পেল।

সে বিদ্রুপের হাসি হেসে বলল, “খলীফা সুলাইমান আপনাকেও জাবালুল ওয়ারস’ –এর জায়গীল দগান করেছেন।


ওটা সম্পর্কে তাহলে আপনার সিদ্ধান্ত কি হবে?”

প্রশ্ন শুনে খলীফা হাসলেন, “তোমার ব্যাপারে সিদ্ধান্তের অনেক আগে খলীফার আসনে বসার সংগে সংগেই জাবালুল ওয়ারস’ সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছি। ওটা যেখান থেকে এসেছে, সেখানেই ফিরে যাবে, তারপর উপযুক্ত প্রার্থীকে তা দিয়ে দেয়া হবে।”

বলে তিনি ছেলেকে দিয়ে সিন্দুক থেকে দলিল-দস্তাবেজ আনালেন।

তারপর ‘জাবালুল ওয়ারস’ –এর দলিলটি বের করে গাসবার সামনেই ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলে দিলেন।

গাসবা আর একটি কথাও না বলে ঘর থেকে বের হয়ে গেল।

ন্যায় ও সুবিচারের ভিত্তিতে যে সব ফরমান অতীতে জারি হয়নি, উমার ইবন আব্দুল আযিয সে সমস্তই বাতিল করে দিয়েছিলেন। ফলে পূর্ববর্তী খলীফারা বনু উমাইয়াকে অন্যায়ভাবে যেসব ভাতা মঞ্জুর করেছিলেন, সে সব বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।

এই সাথে খলীফার এক ফুফুরও ভাতা বন্ধ হয়েছিল। একদিন ফুফু এই অভিযোগ নিয়ে তাঁর কাছে আসলেন।

খলীফা তখন রাষ্ট্রীয় কাজে ব্যস্ত ছিলেন। অল্পক্ষণ পরে আবার তাঁর সামনে গিয়ে দেখলেন খলীফা খেতে বসেছেন।

তাঁর সামনে দু’টুকরো রুটি, একটু লবণ ও সামান্য কিছু তেল।

ফুফু খলীফার খাবারে আয়োজন দেখে বললেন, “কিছু অভাব অভিযোগের কথা বলতে এসেছিলাম, কিন্তু এখন দেখি তোমার অভাব-অভিযোগের কথাই আমাকে বলতে হবে।”

ফুফুর অভিযোগের জবাবে খলিফা বললেন, “কি করব ফুফু আম্মা, এর চেয়ে ভালো খাবার সংগতি আমার নেই।”


ফুফু অনেক ভূমিকার পর বনি উমাইয়ার পক্ষ থেকে বললেন, “তুমি তাদের ভাতা বন্ধ করে দিয়েছ, অথচ তুমি সেসব দান করনি?”

খলীফা বললেন, “সত্য ও ন্যায় যা আমি তাই করেছি।” তারপর তিনি একটি দিনার, একটি জলন্ত অঙ্গারের পাত্র এক টুকরো গোশত আনালেন।

অঙ্গার পাত্রে দিনারটি গরম করলেন, তারপর অগ্নিসদৃশ উত্তপ্ত দিনার গোশতের উপর চেপে ধরলেন। গোশতটি পুড়ে গেল।

খলীফা উমার ইবন আবদুল আযিয সেদিকে ইংগিত করে বললেন, “ফূফুজান, আপনি কি আপনার ভাতিজাকে এরূপ কঠিন শাস্তি থেকে বাঁচাতে চান না?” ফুফু সবই বুঝলেন।

লজ্জিতভাবে ফিরে এলেন খলীফার কাছ থেকে।

যার ভান্ডার শুধু অভাবগ্রস্তদের জন্যই খোলা

রাজধানী দামেসক। খলীফা উমার ইবন আব্দুল আযিয তখন খলীফা আসনে সমাসীন।

মুসলিম বিশ্বের কয়েকজন খ্যাতনামা কবি এলেন দামেসকে। তাঁদের ইচ্ছা, অন্যান্য রাজ দরবারের মত উমার ইবনুল আবদুল আযিযের দরবারে দিয়েও খলীফার কিছু স্তুতিগান করে আর্থিক ফায়দা হাসিল করা।

তাঁরা অনেকদিন রাজধানীতে থাকলেন। সবাই জানল ব্যাপারটা।

কিন্তু খলীফার দরবার থেকে কোন আহবান এলো না।

অবশেষে তাঁরা নিজেরাই খলীফার সাথে সাক্ষাতের মনস্থ করলেন।

সব কবি মিলে সবচেয়ে মুখর ও মশহুর কবি জরিরকে দরবারে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিলেন।

জরির দরবারের দ্বারে এসে সিরিয়ার বিখ্যাত ফকিহ আউস ইবন আবদুল্লাহ হাযালীর মাধ্যমে খলীফার সাক্ষাত প্রার্থনা করলেন।

হযরত আউস গিয়ে জরিরের পরিচয় দিয়ে তাঁর সাক্ষাত প্রার্ণনার কথা বললেন।

খলীফা তাঁকে ডেকে পাঠালেন। কবি জরির খলীফার সমীপে হাজির হয়ে বললেন, “আমি শুনেছি আপনি প্রশংসা-প্রশস্তি ভালোবাসেন না। জনগণের কল্যাণ কামনায় সর্বক্ষণ উদ্বিগ্ন আপনি।

আমি এ ধরণের কিছু কবিতা রচনা করেছি শুনুন।”

কবি জরির হিজাযের ইয়াতীম বালক বালিকা ও বিধবাদের দুঃখ-দুর্দশা বর্ণনা সম্বলিত কবিতা পাঠ করতে লাগলেন।

উমার ইবন আবদুল আযিয মনোযোগ দিয়ে সম্পূর্ণ কবিতা শুনেছিলেন।

দৃষ্টি তাঁর আনত। মুখে অপরিসীম বেদানার ছায়া। দু‘গন্ড বেয়ে অবিরাম ধারায় গড়িয়ে পড়ছিল অশ্রু।

কবিতা পাঠ শেষ হবার সাথে সাথে বাইতুল মালের প্রধান সচিবকে ডেকে পাঠালেন এবং টাকা পয়সা শস্য কাপড় ইত্যাদি সহ একটি সাহায্য কাফেলাকে তৎক্ষনাৎ হিজায যাত্রার নির্দেশ দিলেন।

তারপর তিনি জরিরের দিকে ফিরে বললেন, “আপনি কি মুহাজির?” জরির বললেন, “না, আমি মুহাজির নই।”

আবার জিজ্ঞাসা করলেন খলীফা, “আপিনি কি অবাবগ্রস্ত আনসার অথবা তাদের কোন প্রিয়জন?” জরির বললেন, “না।

খলীফা পুণরায় প্রশ্ন করলেন, “যারা ইসলামের বিজয়ে অংশ গ্রহণ করেছিল, আপনি সেই জিহাদে অংশ গ্রহণকারীদের কোন আত্মীয়?” জরির বললেন, “না। আমি তাদেরও কেউ নই।” খলীফা তখন বললেন, “তাহলে আমার ধারণায় বাইতুল মালে এই মুহূর্তে আপনার কোন অংশ নেই।”

বাকপটু জরির তৎক্ষণাৎ বললেন, “আমি একজন মুসাফির। বহুদুর থেকে আপনার কাছে এসেছি এবং অনেক দিন থেকে আপনার সাক্ষাতের অপেক্ষায় রয়েছি।” খলীফা একটু হেসে বাইতুল মালের সচিবকে কানে কানে কিছু বললেন। বাইতুল মালের সচিব বিশটি দিনার নিয়ে এল।

খলীফা এই বিশটি দিনার কবির হাতে দিয়ে বললেন, “এই দিনার কয়টি আমার এই মুহূর্তে সম্বল। ইচ্ছা হলে এইগুলো গ্রহণ করুন এবং কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করুন অথবা আমার বদনাম করুন।”

কবি জরির বিস্ময় বিমূঢ়, কিন্তু চোখে তাঁর আনন্দের নৃত্য। বললেন তিনি, “বদনাম নয়, আমি এর জন্য গৌরবই বোধ করব,” বলে বিশটি দিনার নিয়েই কবি জরির দরবার ত্যাগ করলেন।

এসে অপেক্ষামান সাথীদের বললেন, “আমি এমন এক রাজ দরবার থেকে এসেছি যার ভান্ডার শুধু দরিদ্র ও অভাবগ্রস্তদের জন্যই খোলা।”

এই বিরান ঘরের সাহায্যেই কি আপন ঘর ঠিক করতে এসেছি?

খলীফা উমার ইবনুল আবদুল আযিয এর বাসগৃহ।

খলীফার পত্নী ফাতিমা উমার ঘরে বসে সেলাই করছিলেন।

এসময় একমহিলা ঘরের দরজায় এসে দাড়াল সে।পরিচয় দিল “আমি সুদূর ইরাক থেকে এসছি।”

ফাতিমা মহিলাটিকে ঘরে এসে বসতে বললেন।

মহিলাটি ঘরে প্রবেশ করে এদিক -ওদিক চাইতে লাগলো।

বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করলো,ঘরে কোন আসবাব পত্র নেই!

সে রাস্ট্রপ্রধান-এর স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললো, ‘এই বিরান ঘরের সাহায্যেই কি আপন ঘর ঠিক করতে এসেছি?’

খলীফা পত্নী তা শুনে বললেন “লোকদের ঘর ঠিক করতে গিয়েই তো এই ঘর বিরাণ হয়েছে।”

এ সময় খলীফা উমার ইবনুল আবদুল আযিয বাড়ি প্রবেশ করলেন।

ঘরের সামনেই একটি কূপ ছিল।তিনি কূপ থেকে পানি তুলে উঠোনের এক জলাধারে ঢালতে লাগলেন।

তিনি পানি ঢালছিলেন আর মাঝে মাঝে ফাতিমার দিকে তাকাচ্ছিলেন।

এটা লক্ষ্য করে ইরাক থেকে আসা মহিলাটি খলীফা পত্নী ফাতিমাকে বললো “আপনি এ বেহায়া লোকটি থেকে কেন পর্দা করেন না? লোকটি তো নির্লজ্জের মত বার বার আপনাকে দেখছে!”

খলীফা পত্নী ফাতিমা হেসে বললেন “ইনি ই তো আমিরুল মুমিনীন।”

খলীফা উমার ইবন আবদুল আযিয ঘরের দিকে এগিয়ে এলেন।

তারপর সালাম করে স্বীয় কক্ষের দিকে চলে গেলেন।

জায়নামাজে যাওয়ার আগে ফাতিমাকে ডেকে মহিলাটির পরিচয় জানতে চাইলেন।ফাতিমা রাস্ট্রপ্রধানকে জানালেন তার আগমনের উদ্দেশ্য।


সব শুনে উমার মহিলাকে ডেকে তার বক্তব্য শুনতে চাইলেন।মহিলা জানালেন “আমি খুব ই অভাবগ্রস্থ,আমার পাঁচটি মেয়ে আছে।


আমি তাদের ভরণ পোষন করতে পারিনা।”


উমার এ কাহিনী শুনে খুব ই ব্যথিত হলেন।সংগে সংগে তিনি দোয়াত কলম নিয়ে ইরাকের গভর্নরকে চিঠি লিখলেন।প্রেসিডেন্ট উমার মহিলার প্রথম,দ্বিতীয়,তৃতীয় আর চতুর্থ মেয়ের জন্য ভাতা নির্ধারন করে দিলেন।


আর বললেন “পঞ্চম মেয়েকে ঐ চারজনের ভাতা থেকেই পরিপোষন করতে হবে।”


মহিলা চিঠি নিয়ে ইরাক চলে এলো।সময় করে দেখা করলো গভর্নরের সাথে।


গভর্নর উমার ইবন আবদুল আযিযের চিঠি পরে কাঁদতে শুরু করলেন।


মহিলাটি উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলেন মুসলিম বিশ্বের আমির উমার ইন্তেকাল করেছেন।


মহিলাটিও কাঁদতে শুরু করলো।


গভর্নর তাকে প্রবোধ দিয়ে বললেন “আপনার আশঙ্কার কোন কারণ নেই।


সেই মহামানবের চিঠির কোন অমর্যাদা কখনো হবেনা।”


গভর্নর চিঠির মর্ম অনুসারে মহিলাটিকে তার প্রাপ্যের ব্যাবস্থা করে দিলেন।


উমার হলেন আল ফারুক


হযরত উমার (রা) ইসলাম গ্রহণ করেই জিজ্ঞাস করলেন, “হে আল্লাহর রাসূল, বর্তমানে মুসলমানদের সংখ্যা কত?” মহানবী (সা) উত্তর দিলেন, “তোমাকে নিয়ে চল্লিশ জন।” উমার বললেন, “এটাই যথেষ্ট।


আজ আমরা এই চল্লিশ জনই কাবা গৃহে গিয়ে প্রকাশ্যে আল্লাহর ইবাদত করব। ভরসা আল্লাহর। অসত্যের ভয়ে আর সত্য চাপা পড়ে থাকতে দেব না।”


উমার (রা) সবাইকে নিয়ে উলংগ তরবারি হাতে ‘আল্লাহু আকবর’ ধ্বনি দিতে দিতে কা’বা প্রাঙ্গণে গিয়ে উপস্থিত হলেন।


মুসলিম দলের সাথে হযরত উমার (রা)-কে এভাবে কা’বা প্রাঙ্গণে দেখে উপস্থিত কুরাইশগন যারপর নাই বিস্মিত ও মনুক্ষুন্ন হয়ে পড়ল।


তাদের মনোভাব দেখে হযরত উমার (রা) পৌরুষকণ্ঠে গর্জন করে বললেন, “আমি তোমাদের সাবধান করে দিচ্ছি, কোন মুসলমানের কেশাগ্র স্পর্শ করলে উমারের তরবারি আজ থেকে তোমাদের বিরুদ্ধে উত্তোলিত হবে।”


কা’বায় উপস্থিত একজন কুরাইশ সাহস করে বলল, “ হে খাত্তাব পুত্র উমার তুমি কি সত্যই মুসলমান হয়ে গেলে? আরবরা তো কদাচ প্রতিজ্ঞাচ্যুত হয় না। জানতে পারি কি, তুমি কি জিনিস পেয়ে এমন ভাবে প্রতিজ্ঞাচ্যুত হলে?”


হযরত উমার উচ্চকণ্ঠে জবাব দিলেন, “মানুষ যার চেয়ে বেশী পাওয়ার কল্পনা করতে পারে না, আমি আজ তেমন জিনিস পেয়েই প্রতিজ্ঞাচ্যুত হয়েছি। সে জিনিস হল আল কুরআন।”


হযরত উমারের (রা) এরূপ তেজোদৃপ্ত কথা শুনে আর কেউ-ই কোন কথা বলতে সাহস পেল না। বিমর্ষ চিত্তে কুরাইশরা সবাই সেখান থেকে চলে গেল।


অতঃপর মহানবী (সা) সবাইকে নিয়ে কাবা ঘরে নামায আদায় করলেন। সেখানে মুসলমানদের এটাই প্রথম নামায। এর আগে মুসলমানরা অতি গোপনে ধর্ম কাজ করতেন। পোশাক-পরিচ্ছদের পার্থক্য রক্ষা করতে পারতেন না।


এজন্য কে মুসলমান, কে পৌত্তলিক তা চিনবার উপায় ছিলনা। এ ঘটনার পর মুসলমানরা পোশাক-পরিচ্ছদ ও ধর্ম কর্মে পৃথক সম্প্রদায়রূপে পরিগণিত হলেন।


এ ঐতিহাসিক পরিবর্তন উপলক্ষে মহানবী (সা) হযরত উমারকে ‘আল ফারূক’ উপাধিতে ভূষিত করলেন।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Be alert before spamming comments.

নবীনতর পূর্বতন

Sponsored

Responsive Ad