বাংলা ২য় পত্র রচনা - ফরমালিন: জনমনে নতুন আতঙ্ক

বাংলা ২য় পত্র রচনা -  ফরমালিন: জনমনে নতুন আতঙ্ক Pharamālin Janamanē natun ātaṅka


বাংলা ২য় পত্র রচনা -  ফরমালিন: জনমনে নতুন আতঙ্ক

ভূমিকা:

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অগ্রগতি নিঃসন্দেহে মানব সভ্যতার সবচেয়ে বড় আশীর্বাদ। সমস্ত বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের পিছনে রয়েছে উপকারী উদ্দেশ্য। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি গবেষণায় মানুষের জীবনকে গতিশীল করতে একের পর এক রাসায়নিক উপাদান তৈরি হচ্ছে। তার মধ্যে ফরমালিন অন্যতম। ফরমালিন তৈরির উদ্দেশ্য ইতিবাচক হলেও বর্তমানে নেতিবাচক কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। বর্তমান বাজারে মানুষের জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় সব খাদ্যপণ্য ফরমালিনের বিষাক্ত ছায়ায় ঢেকে গেছে। ফলে জনমনে একটা অশুভ ভয় কাজ করছে।

ফরমালিন কী:

রাসায়নিক পদার্থ ফরমাল ডিহাইডের পলিমারকে ফরমালিন বলা হয় থাকে, যার রাসায়নিক সংকেত হচ্ছে CH_{2}O। ফরমাল ডিহাইডের ৩০-৪০ শতাংশ জলীয় দ্রবনকে ফরমালিন হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। ফরমাল ডিহাইড সাধারণত দুই ধরনের হয়ে থাকে। প্রথমটি বর্ণহীন গ্যাস এবং অপরটি দেখতে সাদা পাউডারের মতো। উভয় প্রকার ফরমাল ডিহাইড-ই পানিতে সহজেই দ্রবীভূত হয়ে যায় বলে আপাতদৃষ্টিতে তা বোঝা যায় না। তবে যথাযথ পরীক্ষার মাধ্যমে যেকোনো দ্রব্যে ফরমালিন বা ফরমাল ডিহাইডের উপস্থিতি সনাক্ত করা যায়। ফরমাল ডিহাইড একটি অর্গানিক যৌগিক পদার্থ যার মধ্যে মিথানল ও ফরমিক এসিডের সমন্বয় পাওয়া যায়। ফরমালিন সংশ্লিষ্ট সব উপাদানই মানুষের শরীরের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।

বাংলা ২য় পত্র রচনা - বিজ্ঞান শিক্ষার গুরুত্ব বা প্রয়োজনীয়তা

ফরমালিনের আবিষ্কার:

ফরমালডিহাইড বা ফরমালিন আবিষ্কারের সূত্রপাত ঘটে রুশ রসায়নবিদ আলেকজান্ডার বাটলারভ এর হাত ধরে। তিনি ১৮৫৯ সালে তার কাজ শুরু করেন। তবে পূর্ণভাবে ফরমালিন আবিষ্কৃত হয় ১৮৬৯ সালে। জার্মান রসায়নবিদ আগষ্ট উইলহেম ভন হফম্যান এই আবিষ্কারকার্য সমাপ্ত করেন। প্রথম দিকে তারা ফরমাল ডিহাইড উৎপাদন করেন মিথানলের ক্যাটালিটিক অক্সিডেশনের মাধ্যমে। সাধারণ ক্যাটালিস্ট হিসেবে তারা লৌহ ও ভেনাডিয়াম অক্সাইডের মিশ্রণকে ব্যবহার করেন। ফরমালিন তৈরির এই সম্পূর্ণ পদ্ধতিকে বিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় ফরমক্স প্রণালী।


ফরমালিনের ব্যবহার:

আবিষ্কারের পর থেকে ফরমালিনের ব্যবহার ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পায়। বহুমুখী ব্যবহারযোগ্যতার জন্য ফরমালিনের চাহিদা বাড়তে থাকে খুব দ্রুততার সাথে। তবে ফরমালিনের মূল ব্যবহার হচ্ছে কোনো পঁচনশীল দ্রব্যকে সংরক্ষণ করার কাজে। ব্যাকটেরিয়া ধ্বংস করার জন্য ফরমাল ডিহাইডের ব্যবহার খুবই ফলদায়ক। চিকিৎসাবিদ্যার বিভিন্ন কাজে ফরমাল ডিহাইডের ব্যবহার বিদ্যমান। তাছাড়া টেক্সটাইল, প্লাস্টিক, পেপার, রং, কনস্ট্রাকশন ও মৃতদেহ সংরক্ষণে ফরমালিনের ব্যবহার হয়ে থাকে। শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিকারী ঔষধে ব্যাকটেরিয়া নিধনকারী হিসেবে ফরমালিন ব্যবহার করা হয়। ঔষধ উৎপাদনের সময় কাঙ্ক্ষিত ভাইরাসের আক্রমন এড়ানোর জন্য অনেক সময় ফরমালিন ব্যবহার করা হয়। কৃত্রিম উপায়ে কোষ ও টিস্যু সংরক্ষণ করার ক্ষেত্রে ফরমাল ডিহাইডের ব্যবহার ব্যাপক প্রচলিত। বিভিন্ন ড্রাগ ও এলকোহলের মাত্রা পরীক্ষা করার কাজে সালফিউরিক এসিডের সাথে ফরমাল ডিহাইডের দ্রবন ব্যবহত হয়। সর্বোপরি, ফরমাল ডিহাইড বৈজ্ঞানিকভাবে ব্যবহৃত অন্যতম রাসায়নিক উপাদান।


ফরমালিনের উপকারিতা:

ফরমালিন বা ফরমাল ডিহাইড বিজ্ঞানের অনন্য একটি আবিষ্কার। ফরমালিনের উপকারী বৈশিষ্ট্য সমূহ নিম্নে তুলে ধরা হল-

  • রাসায়নিক ও অর্গানিক পদার্থ সমূহের পঁচনরোধে ভূমিকা পালন করে।
  • ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাসের আক্রমনে বাধা দেয়।
  • শিল্প কারখানার যন্ত্রপাতির কার্যক্ষমতা সচল রাখতে সহায়তা করে।
  • মৃতদেহ সংরক্ষণ করে।
  • ঔষুধের গুণাগুণ রক্ষার্থে ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া ধ্বংস করে।
  • কোষ বা টিস্যুকে কৃত্রিম উপায়ে বাঁচিয়ে রাখতে সাহায্য করে।


খাদ্যদ্রব্যে ফরমালিন:

মানুষের কল্যাণার্থে ফরমাল ডিহাইড আবিষ্কৃত হয়েছিল, কিন্তু সময়ের সাথে সাথে এর ব্যবহার বিভিন্ন দিকে মোড় নেয়। এক সময় মানুষ বিভিন্ন নেতিবাচক কর্মকান্ডে ফরমালিনের ব্যবহার করতে শুরু করে। বর্তমানে খাদ্যদ্রব্যে ফরমালিনের ব্যবহার একটি সাধারণ ঘটনায় পরিণত হয়েছে। মাছ থেকে শুরু করে শাক-সবজি এমনকি বিভিন্ন ফলেও ব্যবহার করা হচ্ছে বিষাক্ত ফরমালিন। সংরক্ষণকারী হিসেবে ফরমালিন খুব উপকারী হলেও খাদ্য হিসেবে তা বিষের শামিল। ফরমালিন অনেকাংশে বর্ণহীন ও স্বাদহীন হওয়ায় আপাতদৃষ্টিতে তা বোঝা যায় না। তবে আমরা একটু সচেতন হলেই তা বুঝতে পারি। বিভিন্ন উপায়ে খাদ্যে দ্রব্যে ফরমালিনের উপস্থিতি নিশ্চিত করা যায়। উপায়গুলি নিম্নরূপ-

সন্দেহযুক্ত খাদ্যদ্রব্যটি ধোয়ার পর পানিতে ৩ শতাংশ হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড মেশালে ফরমাল ডিহাইড থেকে ফরমিক এসিড উৎপন্ন হয়। প্রমাণ পাওয়ার জন্য সে পানিতে অল্প মারকুন্ডরিক ক্লোরাইড মেশালে নিচে সাদা রঙের একটি আস্তরণ জমা হয়। এটি মূলত খাদ্যে মিশ্রিত ফরমালিনের প্রমাণ।

ফরমালিনযুক্ত মাছ ধুয়ে তার পানিতে ১ সিসি সোডিয়াম নাইট্রোপ্রোসাইড মেশালে সেই পানি গাঢ় সবুজ-নীল রং ধারণ করে। এতেও ফরমালিনের অস্তিত্ব প্রমানিত হয়।


ফরমালিনের ক্ষতিকর প্রভাব:

ফরমালিন মিশ্রিত খাদ্য গ্রহণ মানুষের শরীরে মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব বিস্তার করে। নিম্নে ফরমালিনে ক্ষতিকর দিকগুলো বর্ণিত হলো-

  • চোখের রেটিনার কোষ ধ্বংস করে।
  • পেটের পীড়া, হাঁচি, কাশি, শ্বাসকষ্ট, বদহজম, ডায়রিয়া, আলসার, চর্মরোগসহ বিভিন্ন রোগের সংক্রমণ হতে পারে।
  • লিভার, কিডনী, হার্ট ও মস্তিষ্কের উপর ধ্বংসাত্মক প্রভাব পড়ে।
  • স্মৃতিশক্তি হ্রাস পেতে পারে।
  • পাকস্থলী, ফুসফুস ও শ্বাসনালীতে ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
  • ফরমিক এসিড রক্তে এসিডিটি বৃদ্ধি করে। ফলে শ্বাস-প্রশ্বাস অস্বাভাবিক হতে থাকে।
  • সন্তান প্রসবের সময় জটিলতা ও বাচ্চার জন্মগত ত্রুটি দেখা দিতে পারে।
  • শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাধাগ্রস্থ হয়।
  • মানুষকে অনিবার্য মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়।


খাদ্য ফরমালিনমুক্ত করার উপায়:

খাদ্যদ্রব্যে ফরমালিনের অস্তিত্ব প্রমাণিত হলে সেটি আর খাদ্য থাকে না, বরং বিষতুল্য হয়ে যায়। তবে খাদ্য থেকে এই বিষক্রিয়া বিভিন্ন উপায়ে দূর করাও সম্ভব। যেমন-

  • ফরমালিনমুক্ত মাছ প্রায় ১ ঘন্টা পানিতে ভিজিয়ে রাখলে বিষক্রিয়া মাত্রা প্রায় ৬০% কমে যায়।
  • লবনাক্ত পানিতে ১ ঘন্টা ভিজিয়ে রাখলে ফরমালিনের মাত্রা ৯০ ভাগ পর্যন্ত কমে যায়।
  • ভিনেগার ও পানির মিশ্রণে ১৫ মিনিট মাছ ভিজিয়ে রাখলে প্রায় ১০০% ফরমালিন দূর হয়।
  • ফল ও সবজি এক ঘন্টা বা তার বেশি পানিতে ডুবিয়ে রেখে রাসায়নিক মুক্ত করা যায়।
  • চাল-ধোয়া পানিতে ও পরে সাধারণ পানি দিয়ে পরিষ্কার করলে মাছ ৭০ ভাগ পর্যন্ত ফরমালিনমুক্ত হয়।


খাদ্যে ফরমালিন বন্ধে করনীয়:

খাদ্যে ফরমালিন মিশিয়ে মানুষকে খাওয়ানো প্রায় তাকে হত্যা করার মতোই। কারণ ফরমালিনের বিষক্রিয়া একজন মানুষকে তাৎক্ষণিক না হলেও ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে ধাবিত করে। জরুরি ভিত্তিতে খাদ্যদ্রব্যে ফরমালিনের প্রয়োগ রোধ করা তাই সময়ের দাবী।

এক্ষেত্রে করণীয় হচ্ছে-

  • ফরমালিন আমদানি করার ক্ষেত্রে সরকারের কঠোর নীতিমালা প্রণয়ন করা উচিত।
  • রাসায়নিক দ্রব্যাদির সহজলভ্যতা রোধ করা উচিত।
  • সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে।
  • খাদ্যে ফরমালিন মেশানোর অপরাধের আইন যথাযথভাবে বাস্তবায়ন খুবই জরুরি।
  • লাইসেন্সধারী প্রতিষ্ঠান ব্যতিত অন্য কেউ যাতে ফরমালিনের আমদানির সুযোগ না পায় সেদিকে লক্ষ্য রাখা উচিত।
  • বাজারে বিদ্যমান খাদ্যসামগ্রী পরীক্ষা নিরীক্ষার সুযোগ তৈরি করা দরকার।
  • খাদ্যে ফরমালিন বন্ধে সংশ্লিষ্ট অপরাধীর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
  • সর্বোপরি, কর্তৃপক্ষের যথাযথ ও কার্যকরী পদক্ষেপ বাস্তবায়নের মাধ্যমে খাদ্যে ফরমালিন বন্ধের ব্যবস্থা করা যায়।


উপসংহার:

পঁচনশীল দ্রব্যাদি যথাযথভাবে সংরক্ষণ করার জন্য আবিষ্কৃত হয় ফরমালিন বা ফরমাল ডিহাইডের পলিমার। এটির ব্যবহার মূলত ইতিবাচক কাজে হওয়ার কথা থাকলেও বর্তমানে তা ব্যবহৃত হচ্ছে পুরোপুরি নেতিবাচক কাজে। ফলে যেখানে ফরমালিনের মাধ্যমে মানবজাতির উপকৃত হওয়ার কথা ছিল সেখানে মানুষ এখন আতঙ্কগ্রস্থ। ফরমালিনের ব্যবহার জনমনে এখন চরম অস্বস্তির জন্ম দিয়েছে। কতিপয় মানুষের অসাধু বিকৃত মানসিকতা মানবজীবনকে দাঁড় করিয়েছে মারাত্মক হুমকির সামনে। তবে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়ার মাধ্যমে এ সমস্যার যুগোপযোগী সমাধান সম্ভব।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Be alert before spamming comments.

নবীনতর পূর্বতন

Sponsored

Responsive Ad