মানুষের হায়াত বা জীবন এবং মউত বা মৃত্যু সম্পর্কে ইসলাম কী বলে?

হায়াত বা জীবন এবং মউত বা মৃত্যু সম্পর্কে ইসলাম কী বলে? What Islam Says About Life and Death



মানুষের হায়াত বা জীবন এবং মউত বা মৃত্যু সম্পর্কে ইসলাম কী বলে?

মানুষের জীবনের তিনটি স্তর জন্ম, মৃত্যু এবং পুনরুত্থান। প্রত্যেক ব্যক্তিকেই অনিবার্যভাবে এ তিনটি পর্যায় অতিক্রম করতে হবে। কারণ মানুষের মূল এবং সবার আদি পিতা হজরত আদম আলাইহিস সালামও সৃষ্টি হয়েছিলেন। তিনি মৃত্যুবরণ করেছেন এবং একদিন পুনরুত্থানও করবেন। এ বিষয়গুলো সম্পর্কে কোরআনুল কারিমের আল্লাহ তাআলা সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা তুলে ধরেছেন। আল্লাহ তাআলা বলেন-

مِنۡهَا خَلَقۡنٰکُمۡ وَ فِیۡهَا نُعِیۡدُکُمۡ وَ مِنۡهَا نُخۡرِجُکُمۡ تَارَۃً اُخۡرٰی

‘মাটি থেকেই আমি তোমাদের সৃষ্টি করেছি, আর আমি মাটিতেই তোমাদের ফিরিয়ে নেব এবং মাটি থেকেই তোমাদের পুনরায় বের করে আনা হবে।’ (সুরা ত্বাহা : আয়াত ৫৫)


হায়াতঃ শরীরের সাথে  ৪   মাস  পর  রূহের সংযোগকে হায়াত বলা হয়।

মউতঃ   মৃত্যুর    সময়   শরীর   থেকে    রূহ্   বিচ্ছিন্ন    হয়ে বরযখ জগতে প্রস্থান করাকে   মউত বলা    হয়।   আরবী ইবারত নিম্নে-

(الموت لیس   بعدم محض وانما ھو  انتقالہ من  حال  الی  حال او الانتقال من دار الی دار)۔

অর্থঃ “অনস্তিত্ব বা বিলীন হয়ে যাওয়ার নাম মউত নয়। মউত  হলো    রূহের  এক   অবস্থা   থেকে  অন্য   অবস্থায়  প্রস্থান   করা।   অর্থাৎ-   এক  জগত  থেকে   অন্য  জগতে প্রস্থান করার নাম”।


বুঝা    গেল-   শরীর   এবং    রূহ্   দুই   জিনিস। মাতৃগর্ভে প্রথমে   ১২০  দিনে    শরীর   তৈরী   হয়।  তারপর  রূহের আগমন হয়। শরীর হচ্ছে পার্থিব বস্তুতে তৈরী, কিন্তু রূহ্ পার্থিব   বস্তু   নয়-  সে    অন্য  জগতের   বাসিন্দা।  মৃত্যুর সময় রূহ্ শরীর  থেকে   বিচ্ছিন্ন হয়ে অন্য জগতে গমন করলেও     শরীরের   সাথে   তার   একটি   কানেকশন   বা যোগাযোগ  সর্বদাই  থাকে। এজন্যই  কবরে  মৃতব্যক্তি  পূনর্জীবিত  হয়,    মুনকার-নকীরের  প্রশ্নের    জবাব  দেয় এবং নেক্কার ব্যক্তি বেহেস্তের শান্তি ভোগ করতে থাকে; আর বদকার ব্যক্তি আযাব ভোগ করতে থাকে।


শরীর থেকে রূহ্ বিচ্ছিন্ন  হয়েও আল্লাহর নিকট জীবিত এবং  রিযিকপ্রাপ্ত  হয়ে    থাকেন-  শহীদগণ,  সিদ্দীকগণ  এবং নবীগণ। তার প্রমাণ নিম্নে উদ্ধৃত করা হলো।


১। আল্লাহ্পাক শহীদগণ সম্পর্কে এরশাদ করেন-

وَلاَ   تَقُولُواْ   لِمَنْ   يُقْتَلُ   فِي   سَبيلِ   اللّهِ   أَمْوَاتٌ   بَلْ   أَحْيَاء  وَلَكِن لاَّ تَشْعُرُونَ

“তোমরা শহীদগণকে মৃত  বলোনা; বরং তাঁরা জীবিত- কিন্তু তোমরা বুঝনা” (সুরা বাক্কারা-১৫৪ আয়াত)।


وَلاَ  تَحْسَبَنَّ  الَّذِينَ  قُتِلُواْ  فِي  سَبِيلِ   اللّهِ  أَمْوَاتًا   بَلْ  أَحْيَاء عِندَ   رَبِّهِمْ   يُرْزَقُونَ   -   فَرِحِينَ   بِمَا   آتَاهُمُ   اللّهُ   مِن   فَضْلِهِ  وَيَسْتَبْشِرُونَ بِالَّذِينَ لَمْ يَلْحَقُواْ بِهِم


“তোমরা শহীদগণকে মৃত বলে  ধারণাও করোনা; বরং তাঁরা  জীবিত  এবং  আল্লাহর  নিকট  তাঁরা  রিযিকপ্রাপ্ত।  আল্লাহর দানে তাঁরা আনন্দিত এবং তাঁদের সাথে যারা এখনও   মিলিত  হয়নি-   তাঁদেরকে   শহীদরা  সু-সংবাদ প্রদান           করে           থাকে”           (আলে-ইমরান-১৬৯-৭০  আয়াত)।


দ্বিতীয় আয়াতে বর্ণিত রিযিকপ্রাপ্তি, আনন্দিত হওয়া ও  সু-সংবাদ   প্রদান   করা-   ইত্যাদি    জীবিত    লোকদেরই গুণাবলী।  শহীদগণ  মর্যাদার   ক্ষেত্রে  তৃতীয়   পর্যায়ের। তৃতীয়    পর্যায়ভূক্ত    হয়ে   যদি   শহীদগণ   জীবিত    বলে প্রমাণিত হয়-  তাহলে দ্বিতীয় পর্যায়ের সিদ্দীকগণ  এবং প্রথম   পর্যায়ের   নবীগণ   যে    স্ব     স্ব     রওযাতে   জীবিত আছেন- তাতে কোনই সন্দেহ নেই।


২।       বিশুদ্ধ      রেওয়ায়াতে     রাসুল     মকবুল     সাল্লাল্লাহু আলাইহি    ওয়া    সাল্লাম    আম্বিয়ায়ে     কেরামের    শরীর  সম্পর্কে এরশাদ করেছেন-

ان  الارض لا  تاکل  اجساد الانبیاء  وفی روایۃ  الطبرانی البیهقی و نبینا حی یرزق

“নিশ্চয়ই এই যমীন আম্বিয়ায়ে কেরামের দেহ মোবারক খেয়ে  হজম করতে  পারেনা”। তাবরাণী   ও  বায়হাকীর  বর্ণনায়   আছে-   “আমাদের   প্রিয়নবী   (ﷺ)  হায়াতুন্নবী এবং রিযিকপ্রাপ্ত”।


বিঃ দ্রঃ লা-মাযহাবীদের নেতা ইসমাঈল দেহলবী এবং এদেশীয় কিছু ওহাবী তাদের পুস্তকে লিখেছে- “ নবীজী মরে,      পঁচে,      গলে       মাটির      সাথে  মিশে গেছেন” (তাকভিয়াতুল      ঈমান)।       তারা      বলে-      “শহীদগণই  জীবিত- নবী  ও   সিদ্দীকগণ জীবিত নন”।  তারা দলীল হিসাবে    বলে-     “যেহেতু      কোরআন      মজিদ    নবী    ও সিদ্দিকগণকে    সরাসরি    জীবিত    বলেনি-    তাই    তারা  জীবিত  নন”।   তাদের  এই    যুক্তিটি   মনগড়া।  কেননা, শহীদগণ তৃতীয় স্তরের মর্যাদা  সম্পন্ন হয়ে যদি জীবিত হন- তাহলে সিদ্দিক ও নবীগণের জীবিত থাকার পৃথক প্রমাণের কোনই প্রয়োজন করেনা। হাদীস শরীফে তো কোরআনের ব্যাখ্যাই উল্লেখ করা হয়েছে। তাদের  এই যুক্তি নবীবিদ্বেষের সুষ্পষ্ট প্রমাণ।

এরূপ   প্রামাণিক   দলীলকে   দালালাতুন  নছ  বলা  হয়। সূতরাং,    কোরআনের     ইবারাতুন্    নছ   দ্বারা   শহীদগণ এবং দালালাতুন নছ দ্বারা  নবী ও সিদ্দীকগণের অক্ষত  শরীর ও হায়াত প্রমাণিত।

৩।       অন্যান্য       নবীগণ       মি’রাজের       রাত্রে       বায়তুল  মোকাদ্দাসে  সশরীরে  আমাদের  প্রিয়  নবীজীর  পিছনে  মোক্তাদী     হয়ে     জামাআতের     সাথে     নামায     আদায়  করেছিলেন বলে সহী বোখারীতে  প্রমাণ আছে। নামায পড়তে  হলে   অষ্ট অঙ্গের প্রয়োজন  হয়- দুই  হাত,   দুই পা,  দুই হাঁটু, নাক  ও  কপাল- সর্বমোট  ৮টি অঙ্গ   দ্বারা নামায আদায় করতে  হয়।  এটাও   নবীগণের সশরীরে  জীবিত থাকার প্রমাণ বহন করে।


বুঝা গেল-  নবীগণের রূহ্ মোবারক কিছু সময়ের জন্য বিচ্ছিন্ন হলেও  পরে   তা ফেরত দেয়া হয়।   নবী  করিম  সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইন্তিকালের  আনুমানিক ৪০   ঘন্টা   পর   মঙ্গলবার   দিবাগত   শেষ   রাত্রে   রওযা  মোবারকে শয়ন করার পর আল্লাহ্ তায়ালা তাঁর পবিত্র রূহ্কে  দেহ   মোবারকে  ফিরত দিয়েছেন। (তকিউদ্দীন সুবুকীর   শিফাউস   সিকাম   এবং   জালালুদ্দীন   সুয়ুতির  আল-হাভী লিল ফতোয়া দ্রষ্টব্য)।

৪।  আবু দাউদ শরীফে হুযুর (ﷺ) -এর রূহ্ মোবারক ফেরত দেয়া সম্পর্কে হুযুর (ﷺ) এরশাদ করেছেন-

مامن مسلم یسلم علی الا رد اللّٰہ  علی روحی حتی ارد علیہ السلام


ইমাম   সুয়ুতি এই হাদীসের অনুবাদ এভাবে করেছেন- “যেকোন মুসলমান আমাকে ছালাম   করলে  আমি  তার সালামের     সরাসরি     জবাব       দেই।     কেননা,     আল্লাহ্ তায়ালা  আমার   রূহ্কে   পূর্বেই  আমার    শরীরে   ফিরত দিয়েছেন” (আল  হাভী)। رد اللّٰہ শব্দটি  অতীত কালের জন্য ব্যবহৃত হয়েছে।

উপরে      বর্ণিত      হাদীস      সমূহের      দ্বারা      ষ্পষ্ট      এবং সন্দেহাতীতভাবে       প্রমাণিত      হলো      যে,       নবীগণের  ইন্তিকালের   অর্থ  হলো-  তিনিরা     লোকচক্ষুর  অন্তরালে  অদৃশ্য   হয়ে   গেছেন।    তিনিরা   জীবিত   ও   অস্তিত্ববান  রয়েছেন-   যদিও   আমরা   তাঁদেরকে   দেখতে   পাইনা।  যেমন-    ফিরিস্তাদের   অস্তিত্ব   রয়েছে,   তাঁরা    আমাদের কাঁধে আছেন- অথচ আমরা তাঁদেরকে দেখতে পাইনা। তাই   নবীগণের    অস্তিত্বের     অবস্থা    হলো    ফিরিস্তাদের অস্তিত্ব     ও     অবস্থার      ন্যায়।      কিয়ামত      পর্যন্ত      তাঁরা অস্তিত্ববান থাকবেন। যখন ইসরাফীল শেষ সিঙ্গায় ফুঁক দিবেন- তখন   জীবিতরা  মরে  যাবে-  কিন্তু নবীগণ  শুধু সাময়িক হুঁশহারা  হবেন। তৃতীয়বার  সিঙ্গায় ফুঁক দিলে অন্যান্যরা   পূণর্জীবিত  হবে  এবং  নবীগণ সম্ভিত ফিরে পাবেন। এদিকে ইঙ্গিত    করেই আল্লাহ্পাক  কোরআন  মজিদে এরশাদ করেছেন-

فاذا نفخ فی الصور (نفخۃ     الصعق  والموت)  فصعق  من فی السموات والارض الامن شاء اللّٰہ

অর্থাৎ- “যখন পুনরুত্থানের উদ্দেশ্যে  সিঙ্গায় ফুঁক দেয়া হবে-  তখন  আসমান  যমীনের  সব  জীবিত  প্রাণী  মরে  যাবে,  কিন্তু  আল্লাহ্  যাদেরকে  ইচ্ছা  করেন-  এ  অবস্থা  থেকে রক্ষা করবেন”।  (নবীগণের  পূনঃ   মৃত্যু হবেনা।   তাঁরা   শুধু    বেহুঁশী   অবস্থা   থেকে    সম্বিত   ফিরে   পেয়ে বোরাকে চড়ে হাশরে যাবেন- কিতাবুর রূহ্)।


৫। বুখারী  ও মুসলিম  শরীফে আমাদের প্রিয় নবীজীর  সম্বিত    ফিরে   পাওয়া   ও   হাশরে   গমন   করা    সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে-

فأكون أول من يفيق» فنبينا أول من يخرج من قبره قبل جميع الناس إلا  موسى  .  فإنه حصل   فيه  تردد    هل بعث قبله   من  غشيته أو بقى  على الحالة  التى كان عليها قبل نفخة الصعق الصور  مفیقا لانہ  حوسب بصعقۃ یوم  الطور ۔


অর্থাৎ-   নবী   করীম   (ﷺ)   এরশাদ   করেছেন- “শেষ  সিঙ্গার ফুঁৎকারের  সময় আমিই  সর্বপ্রথম সম্বিত  ফিরে পাবো”।        আমাদের      প্রিয়নবী      (ﷺ)       সবার      পূর্বে রওযাপাক     থেকে    বের    হয়ে    হাশর     ময়দানে    গিয়ে দেখতে     পাবেন-     হযরত     মুছা     আলাইহিস      সালাম  আরশের পায়া ধরে  দাঁড়িয়ে আছেন। তখন নবী করিম (ﷺ)   দ্বিধায়    পড়ে   যাবেন-    হযরত     মুছা    (আঃ)   কি হুযুরের   পূর্বে    হুঁশপ্রাপ্ত   হয়েছেন-    নাকি    শেষ   সিঙ্গায় ফুঁৎকারের পূর্ব থেকেই সুস্থির অবস্থায় ছিলেন। কেননা, তুর    পর্বতের     ঘটনার     সময়     তিনি     আল্লাহর     নূরের তাজাল্লী দেখে একবার বেহুঁশ হয়ে  পড়ে  গিয়েছিলেন। এজন্যই  হয়তো  আল্লাহ্  তায়ালা  তাঁকে  বেহুঁশী  থেকে  রক্ষা করেছেন। (তাযকিরাহ্)

৬। অন্য রেওয়ায়াতে হযরত কা’ব আহ্বার (রাঃ) বলেন- প্রতিদিন  নিত্যনতুন   এক  লক্ষ     চল্লিশ   হাজার  ফিরিস্তা এসে    রওযা    শরীফে     দাঁড়িয়ে    নূরের    পাখা    বিছিয়ে  দিবারাত্রি    শুধু   ﷺ    শরীফ   পড়তে    থাকেন।   এভাবে কিয়ামত পর্য্যন্ত  চলবে।  শেষ   সিঙ্গায়  ফুঁক  দেয়ার  পর সত্তর    হাজার  ফিরিস্তা  বোরাক    নিয়ে  এসে   নবীজীকে  বোরাকে     চড়িয়ে     মিছিল     সহকারে     প্রিয়     মাহবুবের  দরবারে       হাশরে      নিয়ে       যাবেন      (মিশকাত      বাবুল কারামাত)।

ব্যাখ্যা-   এখানে   একটি   প্রশ্ন   হতে   পারে।   তা   হলো-  প্রথম সিঙ্গার ফুঁৎকারে সমস্ত নবীগণ বেহুঁশ হবেন এবং শেষ     সিঙ্গার    ফুঁৎকারে     সম্বিত    ফিরে    পেয়ে    হাশরে যাবেন।   কিন্তু মুছা আলাইহিস সালাম  একমাত্র  ব্যক্তি- যিনি    ঐদিন    বেহুঁশ      হবেন     না।     তাহলে     তিনি    কি আমাদের নবীর উপরেও মর্যাদাবান?

উত্তর  হলো-  বেহুঁশ  হওয়ার  ঘটনা  পূর্বে  একবার  মুছা  নবীর উপর ঘটেছিল- যখন তিনি তুর পাহাড়ে আল্লাহর নূরের  তাজাল্লী  দেখে  বেহুঁশ    হয়ে   পড়ে  গিয়েছিলেন। তাই   তাঁকে    হাশরের    দিনে    দ্বিতীয়বার    পূনঃ     বেহুঁশ করবেন    না-    বরং     তিনি    সম্বিত    অবস্থায়    আমাদের  নবীজীর    পূর্বেই    হাশরে    গিয়ে    আরশের    পায়া    ধরে  দাঁড়িয়ে   থাকবেন।   এটা    তাঁর    বিরাট    মর্যাদা-   তাতে সন্দেহ    নেই। কিন্তু    এটা    আংশিক    মর্যাদা।    সার্বিক  মর্যাদা   হলো   আমাদের   প্রিয়নবী   সাল্লাল্লাহু   আলাইহি  ওয়া সাল্লামের জন্য।


হায়াত-মউতের বা জীবন-মৃত্যুর স্বরূপ

হাদীস   শরীফে   হায়াতের   স্বরূপ  বলা  হয়েছে  ঘোড়ায়  ন্যায়   এবং    মউতের   স্বরূপ   বলা   হয়েছে    সাদাকালো ডোরাকাটা    খাসীর   ন্যায়।   বিচারের     পর    বেহেস্ত     ও দোযখের     মধ্যখানে      পুলসিরাতের      উপর     মউতকে  ডোরাকাটা খাসীর সুরতে যবেহ্ করে খতম করে  দেয়া হবে। এরপর থাকবে শুধূ হায়াত।


যখন   মউতকে   كبش  املح    বা    সাদাকালো  ডোরাকাটা খাসীর   সুরতে   পুলসিরাতের    উপর  আনা  হবে-  তখন  আমাদের        প্রিয়নবীর          সামনে        হযরত        ইয়াহ্ইয়া আলাইহিস       সালাম,        মতান্তরে       হযরত      জিবরাঈল আলাইহিস  সালাম   উক্ত    ছাগলটিকে   যবেহ্  করবেন। দোযখবাসী  ও  জান্নাত  বাসীদেরকে   তখন   বলা  হবে- ”এখন  আর  মউত  নেই। চিরদিন  হায়াতে  থেকে  যার  যার  কর্মফল ভোগ  করতে থাকো”।  কিতাবের  শেষের  দিকে আরবীসহ বিস্তারিত বয়ান করা হবে।


মউত বা মৃত্যু কেমন?

১।   মউত   সম্পর্কে   সর্বপ্রথম  ধারণা   দিয়েছেন  হযরত আদম   আলাইহিস   সালাম।   যখন    আদম   আলাইহিস  সালামের   প্রথমপুত্র    হাবিল   বিবাহ   সংক্রান্ত     ব্যাপারে নিজভ্রাতা ক্বাবিলের  হাতে শহীদ  হলেন-   তখন হযরত আদম    (আঃ)    এ   সংবাদ   হযরত    হাওয়া    আলাইহাস সালামকে    জানালেন।     তখন    পর্য্যন্ত    মউত     সম্পর্কে হযরত  হাওয়ার  কোন   ধারণা    ছিলনা।  তিনি  জিজ্ঞাসা করলেন- وما الموت অর্থাৎ- মউত কি ও কেমন?


হযরত আদম আলাইহিস সালাম  বল্লেন-

لا یاکل  ولا  یشرب والا یقوم ولا یقعد

অর্থাৎ “মউত হলো-  তখন  খানাপিনা  ও   উঠাবসা  বন্ধ হয়ে যায়। তখন নড়াচড়াও করতে পারেনা”।


একথা শুনে হযরত   হাওয়া (আঃ) চিৎকার করে  কান্না   জুড়ে দিলেন।  তখন হযরত   আদম  আলাইহিস সালাম বল্লেন-

علیک الرنۃ وعلی بناتک ، وانا وبنی منھا براء

অর্থাৎ-  “তুমি এবং    তোমার  পরবর্তী  মেয়ে সন্তানদের উপর    রইলো    রোনাজারি   করার   স্বভাব।   আমি   এবং আমার  পরবর্তী ছেলে সন্তানরা রোনাজারি হতে মুক্ত”।  (হাকীম      তিরমিযি     তাঁর      নাওয়াদিরুল      উছুল     গ্রন্থে মুহাম্মদ  ইবনে  মুনকাদার (তাবেয়ী) সূত্রে  এই বর্ণনাটি দিয়েছেন)।


মানব    ইতিহাসে    হাবিলের    শাহাদাত-ই     ছিল      প্রথম মউত। তাই  বিবি হাওয়াকে সরলভাবে বুঝানোর  জন্য হযরত  আদম  (আঃ)  এভাবে  উদাহরণ  দিয়ে  মউতের  অবস্থা বুঝিয়েছিলেন- হাকীকত সম্পর্কে নয়।


২। আল্লাহর বন্ধুগণের জন্য মউত হলো আল্লাহর সাথে মিলনের সেতু

এ      প্রসঙ্গে     ইমাম     আবু      আবদুল্লাহ   কুরতুবী      তাঁর তাযকিরাহ্  গ্রন্থে  আরো    একটি   ঘটনা  এভাবে   উল্লেখ করেছেন-

وروی ان ملک الموت علیہ السلام جاء الی ابراھیم علیہ السلام    خلیل   الرحمن   عزوجل لیقبض     روحہ۔   فقال  ابراھیم  علیہ   السلام  یا ملک  الموت   ھل  رأیت  خلیلا یقبض روح خلیلہ ؟  فعرج  ملک الموت علیہ  السلام الی ربہ  فقال  :  قل   لہ  ھل  رأیت  خلیلا  یکرہ  لقاء خلیلہ؟ فرجع فقال  اقبض روحی الساعۃ  - وقال ابو الدرداء ص  مامن   مؤمن   الا  والموت  خیر لہ ۔  فمن لم یصدقنی  فان اللّٰہ تعالی یقول وما عند اللّٰہ  خیر للابرار۔ وقال  حبان بن    الاسود الموت   جسر   یوصل     الحبیب    الی    الحبیب۔ التذکرۃ صفحۃ ۰۱

অর্থ- (ইমাম কুরতুবী বলেন)- “বর্ণিত আছে-  মালাকুত মউত  (আযরাঈল আলাইহিস সালাম)   হযরত ইব্রাহীম আলাইহিস সালামের   কাছে তাঁর জীবনের  শেষ মহুর্তে রূহ্     কব্জ   করতে    আসলো।     হযরত    ইব্রাহীম   (আঃ) একথা শুনে   বল্লেন-  হে   মালাকুল মউত! তুমিই বলো- কোন   একান্ত    বন্ধু   কি   আপন   বন্ধুর  রূহ্  কব্জ  করতে  পারেন?   একথা   শুনে   আযরাঈল   (আঃ)   ফিরে   গিয়ে  আল্লাহর    কাছে   আরযি   দিলেন।  আল্লাহ্   বল্লেন-  তুমি গিয়ে আমার খলীল (একান্ত   প্রাণ উৎসর্গকারী)   বন্ধুকে বলো-  “আপনিই   বলুন-  কোন    বন্ধু    কি  আপন  ঘনিষ্ট বন্ধুর     ডাকে    সাড়া     দিতে    আপত্তি      করতে    পারে”? আযরাঈল ফিরে এসে একথা শুনালে হযরত ইবরাহীম (আঃ)  ভাবোন্মত্ততায় বলে উঠলেন- “তাহলে   দেরী   না করে    এই     মুহুর্তেই    আমার   রূহ্   কব্জ    করো”   (এবং  আমাকে বন্ধুর সান্নিধ্যে পৌঁছিয়ে দাও)”।


এটা  ছিল প্রেমাস্পদের  সাথে   মিলনের উদ্দেশ্যে মউত কামনা  করা।  এটা  অতি  উত্তম।   হযরত   আবু    দারদা  রাদিয়াল্লাহু  আনহু  বলেছেন- “যেকোন  মুমিনের  কাছে  মৃত্যুই   তাঁর   জন্য    উত্তম”।   (কেননা,      এর      দ্বারা   সে মাহবুবে হাকিকীর সাথে মিলনের সুযোগ পায়)। হযরত আবু দারদা (রাঃ) বলেন- “কেউ যদি আমার কথা সত্য মনে না করে- তাহলে সে যেন আল্লাহর এই বাণী পড়ে নেয়-  “আল্লাহর   দরবারে   যেসব   নেয়ামত  ও  পুরস্কার রয়েছে- তা নেক্কারদের জন্য অতি উত্তম”। (সুরা আলে ইমরান ১৯৮ আয়াত)।


হাইয়ান   ইবনে    আসওয়াদ   (রহঃ)    বলেছেন-   “মউত  হলো সেতুবন্দ স্বরূপ- যা এক বন্ধুকে অন্য বন্ধুর কাছে পৌঁছিয়ে দেয়”। (তাযকিরাহ্ ১০ পৃঃ)


সুতরাং  কোন    কোন  ক্ষেত্রে  প্রেমাকর্ষণে    মৃত্যু  কামনা করা অতি উত্তম। বুঝা গেলো- দুনিয়ার ঝামেলায় মৃত্যু কামনা করা জায়েয নেই। ঈমান রক্ষা করা কিংবা বন্ধুর সাথে    মিলনের   আকাংখায়   মৃত্যু    কামনা   করা   যেতে পারে।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Be alert before spamming comments.

নবীনতর পূর্বতন

Sponsored

Responsive Ad