বিজ্ঞানী আর্কিমিডিসের আবিষ্কার এবং অজানা কিছু তথ্য ভাণ্ডার

বিজ্ঞানী আর্কিমিডিসের আবিষ্কার এবং অজানা কিছু তথ্য ভাণ্ডার - Discoveries of the scientist Archimedes and some unknown information

 

বিজ্ঞানী আর্কিমিডিসের আবিষ্কার এবং অজানা কিছু তথ্য ভাণ্ডার

অনেকগুলো দ্বীপ নিয়ে সিসিলি গঠিত। তেমনি একটি দ্বীপ সিসিলির বন্দরনগরী, নাম সিরাকুস। খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীতে সিরাকুস ছিলো ব্যবসা, কলা এবং বিজ্ঞানের প্রাণকেন্দ্র। সিরাকুসে’র একজন জ্যোতির্বিদ এবং গণিতবিদ “ফিডাসের” ঘরে ২৮৭ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে একটি পুত্রসন্তান জন্মগ্রহন করেন। আর এই শিশুপুত্রটিই হলেন আর্কিমিডিস। আর্কিমিডিসের শিশুকাল সম্পর্কে খুব বেশী তথ্য জানা যায় না। আর্কিমিডিস ছিলেন জ্ঞান পিপাসু। তিনি জ্ঞানের পূণ্যভূমি মিশরের আলেকজান্দ্রিয়ায় পাড়ি জমান বিদ্যা লাভের আশায়। ৩৩১ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে আলেকজান্দার দ্যা গ্রেট কর্তৃক আলেকজান্দ্রিয়া নগর প্রতিষ্ঠিত হয়। সে সময়ে আলেকজান্দ্রিয়ায় ইউক্লিড নাম্নী প্রখ্যাত গণিতবিদ বাস করতেন। তিনি গ্রীসের জ্যামিতি বিষয়ক সূত্র, সম্পাদ্য, উপপাদ্য সংগ্রহ করে একটি বই লেখেন। সেই বই “দ্যা এলিমেন্টস” দুইহাজার বছর ধরে জ্যামিতি শিক্ষার মৌলিক বই হিসেবে অভিহিত হয়ে আসছে।  বিদ্যালাভ শেষ করে আর্কিমিডিস সিরাকুসে ফিরে আসেন।

আর্কিমিডিসের স্ক্রুঃ 

সিরাকুসের রাজার নাম দ্বিতীয় হিয়েরো। গ্রীক লেখক এথেনাস অফ নক্রেতিসের লেখা থেকে জানা যায়, রাজা বিশাল এক জাহাজ নির্মান করেন। সেই সময়ে সেই জাহাজে ছয়শত লোক আরোহন করতে পারত। জাহাজে বাগান, জিমনেসিয়াম এবং দেবী আফ্রোদিতির মন্দির ছিলো। একবার রাজা হিয়েরোর জাহাজের খোলে বেশ বৃষ্টির পানী জমে গেলো। এতবড় জাহাজ থেকে পানি সেঁচা বেশ ঝামেলা হয়ে যাচ্ছে। কিং হিয়েরো আর্কিমিডিসকে ডেকে পাঠালেন। সমস্যার সমাধান করে দাও পন্ডিত। আর্কিমিডিস একটা মেশিন তৈরী করলেন। তিনি একটি ফাঁপা টিউব নিলেন। টিউবের ভিতর একটি দন্ড রাখা হলো। দন্ডের গায়ে সর্পিলাকার প্যাচানো মোটা কয়েল লাগানো। দন্ডের একমাথায় হাতল লাগানো। হাতল ঘোরালে পানি জাহাজের খোল থেকে টিউব বেয়ে বাইরে এসে পড়ছে। উন্নয়নশীল দেশে চাষাবাদের জন্য ভূগর্ভ থেকে পানি উত্তোলনের জন্য আর্কিমিডিসের সুত্র আজো ব্যবহার করা হয়। ভিট্রুভিয়াসের বর্ণনা থেকে জানা যায় রোমানরা আর্কিমিডিসের স্ক্রুর ব্যবহার জানতেন। পৃথিবীর সপ্তাচার্য্যের অন্যতম আশ্চর্য্য ব্যবিলনের ঝুলন্ত উদ্যানে স্ক্রু পাম্পের সাহায্যে পানি সেঁচ দেয়া হত। ১৮৩৯ সালে পৃথিবীর প্রথম স্টিম চালিত জাহাজ জলে ভাসে। সে জাহাজে আর্কিমিডিসের স্ক্রু’র মত স্ক্রু প্রোপেলার ব্যবহার করা। আর্কিমিডিসকে সম্মনা দেখিয়ে জাহাজের নামকরণ করা হয় এসএস আর্কিমিডিস।


ভরের নিত্যতা সুত্রঃ 

ভিট্রুভিয়াসের বর্ণনানুসারে, সিরাকুসের রাজা হিয়েরো দেবতার মন্দিরে উৎসর্গ করার জন্য নতুন একটি রাজমুকুট তৈরী করতে চাইলেন। নবনির্মিত রাজমুকুটটি হতে হবে নিখাদ সোনার। স্বর্নকারকে ডাকা হলো। স্বর্নকার রাজী হলো। রাজার হুকুমে গররাজী হবার সাহস রাজ্যে কার আছে! তিনি স্বর্নকারের বাড়ি খাঁটি সোনা পাঠিয়ে দিলেন। এরপর রাজার অপেক্ষার পালা। একসময় রাজমুকুট রাজগৃহে রাজদরবারে হাজির করলো স্বর্নকার। রাজা জহুরিকে দিয়ে ওজন করিয়ে নিলেন। নাহ! রাজার দেয়া স্বর্নের সমান ওজনের এই মুকুট। তবু রাজার মনে সন্দেহ হতে লাগলো। স্বর্ণকারদের স্বভাব হলো চুরি করা। সে নিশ্চিত কিছু সোনার সাথে রূপা মিশ্রিত করে এই মুকুটের ওজন ঠিক রেখেছে। ফাঁকি দিয়ে সে যাবে কোথায়। ডাকো আর্কিমিডিসকে। আর্কিমিডিসকে ডাকা হলো। রাজার মুকুটটি  খুব পছন্দ হয়েছে। তিনি এটা ভাঙতে রাজী নন।


রাজা হিয়েরো আর্কিমিডিসকে খুব পছন্দ করতেন। পৃথিবীর অধিকাংশ শাসকই শিল্প সাহিত্যের কদর করতেন। কিন্তু তাদের একটা বদ স্বভাব ছিলো। কোন কিছুর নির্দেশ দিলে বলতেন, এটা তোমাকে করতে হবে নাহলে তোমার গর্দান নেবো। রাজা আর্কিমিডিস’কে বললেন মুকুটের খাদ নির্ণয় করতে কিন্তু মুকুটটিকে ভাঙা যাবে না। আর্কিমিডিস খুব টেনশানে পড়ে গেলেন। টেনশানে পড়লে আমাদের অনেকেই নাওয়া খাওয়া ছেড়ে দেয়। আর্কিমিডিস খাওয়া ছেড়েছিলেন কিনা জানিনা কিন্তু নাওয়া ছাড়েন নাই। স্নান করা ছেড়ে দিলে ভরের এই বিখ্যাত নিত্যতা সুত্র আবিষ্কৃত হত কিনা তা বলা যায় না। আর্কিমিডিস হাম্মাম খানায় গোসল করতে গেলেন। তখনকার দিনে মানুষ হাম্মামখানায় গোসল করতে যেত। সকল কাপড় খুলে রেখে উদোম গায়ে বাথটাবে শুয়ে গোছল করত। আর্কিমিডিস চিন্তায় ডুবে ছিলেন। কানায় কানায় টইটুম্বুর বাথটাবে তিনি নামলেন। কিছু জল উপচে পড়ল। আর্কিমিডিসের মাথায় বিদ্যুৎ খেলে গেলো। তিনি সহসা তার সমস্যার সমাধান করে ফেললেন। তিনি সোনার মুকুটের আয়তন বের করতে পারবেন মুকুটটি দ্বারা অপসারিত পানির পরিমান দ্বারা। বস্তুর দ্বারা অপসারিত পানির আয়তন এবং বস্তুর আয়তন সমান। আর্কিমিডিস তার নিজের আবিষ্কারে মুগ্ধ হলেন। তার আর তর সইছিলো না। সে তখনি রাজ প্রাসাদে ছুটলেন। তার খেয়াল ছিলোনা যে তার পরনে কোন পোষাক নাই। সিসিলির রাস্তা দিয়ে নগ্ন আর্কিমিডিস “ইউরেকা” “ইউরেকা” বলে চিৎকার করে দৌড়াতে লাগলেন। গ্রীক ভাষায় ইউরেকা বলতে বোঝানো হয় আমি পেয়েছি। গ্রীকঃ "εὕρηκα!"। সোনার সাথে যদি অন্য কোন কম ঘনত্বের ধাতু মেশানো হয় তবে অপসারিত পানির পরিমান সমপরিমান খাঁটি সোনা দ্বারা অপসারিত পানির পরিমানের থেকে কম হবে। আর্কিমিডিস পরীক্ষা দ্বারা প্রমান করলেন মুকুটে রূপা মিশিয়ে ভেজাল দেয়া হয়েছে। চতুর্থ অথবা পঞ্চম শতাব্দীতে লিখিত লাতিন কবিতা “কারমেন দে পনদেরিবাস এট মেনসুরিস”য় আর্কিমিডিসের সোনার মুকুটের খাঁদ নির্ণয়ের কথা বলা হয়েছে।


আর্কিমিডিসের মৃত্যুঃ 

ভৌগলিক ও রাজনৈতিক কারণে সিসিলি গুরুত্বপূর্ন অবস্থানে ছিলো। রোমান এবং কার্থেজদের মধ্যে ভয়াবহ দ্বিতীয় পুনিক যুদ্ধ শুরু হয়। দুই দেশের মাঝখানে অবস্থিত হওয়ায় স্বভাবতই সিসিলি যুদ্ধকে এড়িয়ে যেতে পারলো না। আর্কিমিডিসের গাণিতিক কৌশলে দুই বছরের মত সিরাকুস আত্মরক্ষা  করতে সমর্থ হয়। আর্কিমিডিস সমুদ্র উপকূলে বিশাল বিশাল দর্পণ স্থাপন করেন। সূর্য্যরশ্মিকে দর্পণে প্রতিফলিত করে তিনি শত্রুজাহাজে আগুন ধরিয়ে দিতেন। তখনকার সময়ে জাহাজ নির্মিত হত কাঠ দিয়ে। কাঠ আর আগুনের সম্পর্ক তো আমাদের সবার জানা। কোথাও কিছু নেই। হঠাৎ গরম হাওয়া এসে জাহাজে আগুন ধরিয়ে দিচ্ছে। ভৌতিক এই ব্যাপারে শত্রুপক্ষ কাবু হয়ে গেলো। তারপর একসময় রোমানরা শহর দখল করে নেয়। বিখ্যাত ইতিহাসবিদ প্লুতার্কের বর্ণনা অনুসারে খ্রিষ্টপূর্বাব্দ ২১২ সালে “মারকুস ক্লডিয়াস মারসেলাস” সিরাকুস দখল করে নেন। মারসেলাস গণিতবিদ আর্কিমিডিসকে খুব শ্রদ্ধা করতেন। তিনি মহামান্য এই মনিষীকে দেখতে চাইলেন। তিনি সৈন্যদের বললেন আর্কিমিডিসকে তার দরবারে হাজির করতে। রাজানুগত সৈন্যদের স্বভাবটাই এরকম যে ধরে আনতে বললে বেঁধে আনে। দেশে এই দূর্যোগ চলছে আর্কিমিডিসের সেদিকে কোন খেয়াল নেই। তিনি গণিতের জটিল কোন সমস্যার সমাধানে মগ্ন ছিলেন। সৈন্য আর্কিমিডিসকে আদেশ দিলো তার সঙ্গে মারসেলিয়াসের গৃহে যাওয়ার জন্য। আর্কিমিডিস সৈন্যের আদেশ প্রত্যাখান করে আবার গাণিতিক সমস্যার সমাধানে নিমগ্ন হলেন। অনেকে বলে থাকেন আর্কিমিডিসের শেষ উক্তি ছিলো “আমাকে বিরক্ত করো না।” [ইংরেজীঃ "Do not disturb my circles" (গ্রীকঃ μή μου τοὺς κύκλους τάραττε), (ল্যাতিনঃ "Noli turbare circulos meos,")] আর্কিমিডিস যে শেষ মূহুর্তে এই কথাটি বলেছিলেন সে বিষয়ে গ্রহনযোগ্য কোন উৎস খুঁজে পাওয়া যায় না। হাতে অস্ত্র থাকলে মানুষের স্বভাব এমনিতেই হিংস্র হয়ে যায়। সৈন্য তার মেজাজকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেন না। কোষ থেকে তরবারি উন্মুক্ত করে আর্কিমিডিসের গর্দান বরাবর চালিয়ে দিলেন। পৃথিবী এক মহা মানবকে চিরতরে হারালো। পঁচাত্তর বছর বয়সে। ঠিক হারিয়ে যায় নি। আমি তুমি আমরা সবাই একদিন নেই হয়ে যাবো। অনাগত ভবিষ্যত আর্কিমিডিসের মত কিছু জ্ঞানপিপাসু মহামানবকে চিরদিন মনে রাখবে।

আর্কিমিডিসের মৃত্যুর খবর পেয়ে মারসেলাস বড়ই ব্যথিত হলেন। সেকালে শত্রু পক্ষের লোকের লাশকে নানাভাবে নিঃগৃহিত করা হত। মারসেলাস যথাযথ সম্মান সহকারে আর্কিমিডিসের শেষকৃত্যু সম্পাদনের নির্দেশ দিলেন। আর্কিমিডিসের পূর্ব ইচ্ছা অনুযায়ী তার সমাধিতে একটি সিলিন্ডারের ভিতরে গোলক রাখা হয়। এটি আর্কিমিডিসের বিখ্যাত একটি আবিষ্কার। স্কুলে পড়ার সময় আমরা অনেকেই পড়েছি। গোলকের আয়তন সিলিন্ডারের আয়নের দুই তৃতীয়াংশ। কিন্তু কখনো কি জানার চেষ্টা করেছি সর্বপ্রথম কে এটা প্রমান করেন?

খ্রিষ্ট্রপূর্ব ৭৫ অব্দে আর্কিমিডিসের মৃত্যুর ১৩৭ বছর পর সিসিলি শাসন করতেন রোমান রাজা ওরাতোর সিসেরো। তিনি আর্কিমিডিসের সমাধি সম্পর্কে অবগত হলেন। কিন্তু এর অবস্থান সম্পর্কে সঠিক কোন তথ্য জানতেন না। স্থানীয় লোকেরা কোন তথ্য জানাতে পারলো না। সিরাকুসের এগরিগেন্টেন গেটের কাছাকাছি জায়গায় তিনি আর্কিমিডিসের পরিত্যক্ত সমাধি খুঁজে পান। ভগ্ন সমাধির গায়ে বুনো লতা জন্মেছে প্রচুর পরিমানে। সিসেরো সমাধিকে পরিচ্ছন করেন। তিনি সমাধি গাত্রে লেখা কিছু লিপি’র পাঠোদ্ধার করতে সক্ষম হন। তারপর একসময় কালের গর্ভে আর্কিমিডিসের সমাধি আবার হারিয়ে যায়। ১৯৬০ সালে সিরাকুসের এক হোটেলের উঠোনে পরিত্যক্ত এক সমাধিকে আর্কিমিডিসের সমাধি বলে দাবি করা হয়।



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Be alert before spamming comments.

নবীনতর পূর্বতন

Sponsored

Responsive Ad