হযরত ইউসুফ আ. এর ঘটনা ও জীবন কাহিনী থেকে শিক্ষা

হযরত ইউসুফ আলাইহিস সালাম এর ঘটনা ও জীবন কাহিনী থেকে আমাদের শিক্ষা

 

হযরত ইউসুফ আলাইহিস সালাম এর ঘটনা ও জীবন কাহিনী থেকে আমাদের শিক্ষা

সুপ্রিয় ইসলামী ভাই ও বোনেরা আজকে আমরা জানবো হযরত ইউসুফ আলাইহিস সালামের সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনা থেকে আমাদের জন্য কি কি শিক্ষা রয়েছে সে বিষয়ে । আসলে প্রত্যেক নবী আলাইহিমুস সালামের জীবনী আমাদের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে নেয়ামত স্বরুপ । আলহামদুলিল্লাহ হযরত সৈয়্যদেনা ইউসুফ আলাইহিস সালামের ঘটনাও আমাদের জন্য অনেক বড় একটা নেয়ামত। বাস্তবে যদি আপনি আজকের পোস্ট একটু সময় নিয়ে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পড়েন । তাহলে আমি নিশ্চিত আপনার জীবনকে সুন্দরভাবে সাজাতে পারবেন । 

তো চলুন শুরু করা যাক -


(এক) ইউসুফ আ. এর ভাইয়েরা যখন তাঁর পিতার কাছে তাঁর কাপড় অক্ষত অবস্থায় নিয়ে আসেন, তখন হযরত ইয়াকুব আ. ইউসুফ আ. এর পোশাক অক্ষত দেখে তিনি তার ছেলেদের দাবি অস্বীকার করেছিলেন। এর অর্থ হল বিচারকের উভয় পক্ষের দাবি এবং যুক্তির পাশাপাশি পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি এবং প্রমাণ বিবেচনা করা উচিত।

(দুই) জুলাইখা তার ইচ্ছা পূরণের জন্য ইউসুফ আলাইহিস সালামকে একটি নির্জন কক্ষে প্রলুব্ধ করতে শুরু করলে, ইউসুফ আলাইহিস সালাম তৎক্ষণাৎ ঘর থেকে বেরিয়ে যান। অর্থাৎ যে স্থানে গুনাহ হওয়ার আশঙ্কা থাকে সে স্থান পরিত্যাগ করতে হবে। আর এক্ষেত্রে আপনাকে আপনার সম্ভাব্য সমস্ত শক্তি নিয়োগ করতে হবে- যেমনটি হযরত ইউসুফ আলাইহিস সালাম করেছিলেন।

(তিন) যদিও এর ফলাফল বাহ্যিকভাবে দেখা যায় না, তবুও মানুষের কর্তব্য হলো আল্লাহ তায়ালার নির্দেশ অনুসরণে ভুল না করা। পরিণতি আল্লাহর হাতে। বান্দার কর্তব্য হলো আল্লাহর রাস্তায় প্রচেষ্টা ব্যয় করে দাসত্ব প্রদর্শন করা। উদাহরণস্বরূপ, ইউসুফ আলাইহিস সালাম ঐতিহাসিক বর্ণনা অনুসারে সমস্ত দরজা বন্ধ এবং তালাবদ্ধ থাকা সত্ত্বেও দরজার দিকে দৌড়ানোর জন্য তাঁর সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করেছিলেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে অদৃশ্য সাহায্যের আগমন প্রত্যক্ষ করা হয়। প্রকৃতপক্ষে, বান্দা যখন তার প্রচেষ্টা পূর্ণ করে, তখন আল্লাহ তার জন্য সফলতার পথ খুলে দেন। যেমনটি হযরত ইউসুফ আলাইহিস সালামের ক্ষেত্রে দেওয়া হয়েছে। সমস্ত দরজা স্বাভাবিকভাবেই খুলে গেল এবং তার জন্য বেরিয়ে আসার পথ তৈরি করল।

(চার) বর্ণিত আছে যে, যখন ইউসুফ (আলাইহিস সালাম)-কে কারাগারে পাঠানো হয়েছিল, তখন আল্লাহর পক্ষ থেকে ওহী আসে- আপনি নিজেকে কারাগারে নিক্ষেপ করেছেন। কেননা আপনি বলেছেন, হে মহারাজ, এই মহিলারা আমাকে যে কাজের জন্য ডাকে তার চেয়ে আমি কারাগার পছন্দ করি। আপনি যদি কারাগার ছাড়া অন্য নিরাপত্তা চাইতেন তাহলে আপনাকে পূর্ণ নিরাপত্তা দেওয়া হতো। এর থেকে বোঝা যায় যে, আমি যে বড় বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য প্রার্থনা করছি তার চেয়ে অমুক ছোট বিপদকে আমি উত্তম মনে করা উচিত নয় । বরং ছোট-বড় সকল বিপদ-আপদ থেকে পরিপূর্ণ মুক্তি ও নিরাপত্তার জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করা উচিত।

(পাঁচ) আলোচিত কাহিনীতে উল্লেখ করা হয়েছে যে, কারাগারে দুইজন বন্দী হযরত ইউসুফ আলাইহিস সালামকে তাঁর স্বপ্নের ব্যাখ্যা জানতে চাইলে তিনি তাদের একটি ধর্মীয় আমন্ত্রণ পেশ করেন, স্বপ্নের ব্যাখ্যার আগে ঈমান ও একেশ্বরবাদের অনুশীলন সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেন। এর অর্থ এই যে, কেউ যদি কোনো মুসলমানের কাছে কোনো বিষয়ে আসে এবং সে দ্বীনের ব্যাপারে গাফিলতি থাকে, তাহলে তার দায়িত্ব হলো প্রথমে তার সাথে ঈমান ও আমলের বিষয়ে আলোচনা করা এবং তাকে দ্বীনের দাওয়াত দেওয়া। তারপর তার উচিত তার উল্লেখিত বিষয়টি মিটিয়ে ফেলা।

(ছয়) রাজার স্বপ্নের ব্যাখ্যা করার পর হযরত ইউসুফ (আলাইহিস সালাম) তাঁকে রাষ্ট্র পরিচালনার বিষয়ে কিছু পরামর্শ দেন। এই সময়ে যখন জরুরী প্রয়োজন দেখা দিল, তখন এই বড় পরিকল্পনা কিভাবে পরিচালিত হবে এবং কে করবে? এরপর হযরত ইউসুফ আলাইহিস সালাম রাজাকে উত্তরে বললেন, “আমাকে জমির ফসলসহ দেশের সম্পদের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে নিযুক্ত করুন। আয়াতের এই অংশটি ইঙ্গিত করে যে যদিও সাধারণত নিজের জন্য একটি পদ চাওয়া নিষেধ, তবে এটি যদি কখনও এমন পর্যায়ে আসে যেখানে এটা নিশ্চিত যে অন্য কেউ সঠিকভাবে কাজটি সম্পাদন করতে পারবে না, তবে কাজটি পরিচালনার জন্য, তিনি জাতির সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করতে পারেন। তেমনিভাবে কোন বিশেষ পদ সম্বন্ধে যদি জানা যায় যে, অন্য কোন ব্যক্তি এর সুষ্ঠু ব্যবস্থা করতে সক্ষম হবে না এবং নিজে ভালরূপে তা সম্পাদন করতে পারবে বলে দৃঢ় আত্মবিশ্বাস থাকে এবং তার মধ্যে কোন গুণাহে লিপ্ত হওয়ারও আশংকা না থাকে, তাহলে দেশ ও জনগণের বৃহৎ কল্যাণের জন্য তার পক্ষে উক্ত পদের প্রার্থী হওয়া জায়িয।

তবে শর্ত এই যে, প্রভাব-প্রতিপত্তি ও অর্থ-কড়ির মোহে নয়, বরং উক্ত পদের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের খিদমত ও ইনসাফের সাথে তাদের অধিকার সংরক্ষণ করাই উদ্দেশ্য থাকতে হবে এবং তা সেভাবেই আনজাম দিতে হবে, যেমন হযরত ইউসুফ আ. এর দ্বারা হয়েছিল। আর যেখানে এরূপ অবস্থা না হয়, সেক্ষেত্রে রাসূলে কারীম ﷺ কোন পদ প্রার্থনা করতে বা প্রার্থী হতে নিষেধ করেছেন। বরং যদি কেউ কোন পদের জন্য আবেদন করেছে, তিনি তাকে সেই পদ দেননি। 

(সাত) হযরত ইউসুফ আ.-এর ঘটনা থেকে বুঝা যায় যে, দেশের অর্থনৈতিক দুরবস্থা যদি এমন চরমে পৌছে যে, সরকার কোন ব্যবস্থা না নিলে অনেক লোক জীবন ধারণের অত্যাবশ্যকীয় দ্রব্যসামগ্রী থেকে বঞ্চিত হয়ে পড়বে, তখন সরকার এ ধরনের দ্রব্যসামগ্রীকে নিজ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিতে পারে এবং খাদ্যশস্যের উপযুক্ত মূল্যও নির্ধারণ করে দিতে পারে। কিন্তু সাধারণ অবস্থায় মূল্য নির্ধারণ করে দেয়া সরকারের জন্য ঠিক নয়।

অবশ্য যদি কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠী সিন্ডিকেট করে দ্রব্যের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে দ্রব্যমূল্য বাড়িয়ে অধিক মুনাফা লুটতে থাকে, সরকার তাকে বা তাদেরকে কঠোর হস্তে দমন করবে এবং বাজারে দ্রব্যের স্বাভাবিক সরবরাহ নিশ্চিত করে দ্রব্যমূল্য স্বাভাবিক রাখতে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।

(আট) ইউসুফ আ. এর ভাইয়েরা যখন দ্বিতীয়বার মিসরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিয়েছিলেন, তখন ইয়াকূব আ. তাদেরকে মিসর শহরে প্রবেশ করার ব্যাপারে একটি বিশেষ উপদেশ দিয়েছিলেন যে, তোমরা এগারো ভাই শহরের একই প্রবেশ দ্বার দিয়ে প্রবেশ করো না, বরং নগর প্রাচীরের কাছে গিয়ে আলাদা হয়ে যেয়ো এবং ভিন্ন ভিন্ন দরজা দিয়ে প্রবেশ করো। কারণ এতে করে  কারো কুদৃষ্টি পড়ার সম্ভাবনা আছে। এ দ্বারা জানা গেল যে, বদ নজর লাগা সত্য ও বাস্তব বিষয়। সুতরাং ক্ষতিকর খাদ্য ও ক্ষতিকর ক্রিয়াকর্ম থেকে আত্মরক্ষার ন্যায় এবং এর প্রভাব থেকে মুক্ত হতে তদবীর করার ন্যায় এ বদনজর থেকে আত্মরক্ষার ব্যবস্থা করা এবং এর কুপ্রভাব থেকে আত্মরক্ষার ব্যবস্থা করা এবং এর কুপ্রভাব থেকে মুক্তির জন্য তদবীর করাও সমভাবে শরীয়তসিদ্ধ।

(নয়) এ থেকে আরও বুঝা গেল যে, যদি কেউ অন্য কারো সম্পর্কে দুঃখ-কষ্টে পতিত হওয়ার আশঙ্কা পোষণ করে, তবে তাকে সে ব্যাপারে অবহিত করা এবং দুঃখ-কষ্টের হাত থেকে আত্মরক্ষার সম্ভাব্য উপায় বলে দেয়া উচিত, যেমন ইয়াকূব আ. ইউসুফ ভ্রাতাদের ব্যাপারে করেছিলেন।

(দশ) হযরত ইয়াকূব আ. নিজ ছেলেদেরকে কুদৃষ্টি থেকে আত্মরক্ষার তদবীর বাতলে দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে একথাও বলেছিলেন যে, আমি জানি-এ তাদবীর বাতলে দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে একথাও বলেছিলেন যে, আমি জানি-এ তদবীর আল্লাহ তা‘আলার ইচ্ছাকে এড়াতে পারবে না। হুকুম একমাত্র তাঁরই চলে। তবে মানুষের উপর বাহ্যিক চেষ্টা-তাদবীর করার নির্দেশ আছে। তাই এ উপদেশ দেয়া হয়েছে। কিন্তু আমি এ তদবীরের উপর ভরসা করি না, বরং একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার উপরই ভরসা করি। অর্থাৎ এ তদবীরের দ্বারা কিছুই হবে না, তবে আল্লাহ যদি স্বীয় অনুগ্রহে তোমাদের হেফাযত করেন, তবেই তোমরা হিফাযতে থাকতে পারবে।

হযরত ইয়াকুব আ. এর এ বক্তব্যে এ কথা স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, মুসলমানদের কর্তব্য হচ্ছে-প্রত্যেক কাজে আসল ভরসা আল্লাহ পাকের উপর রাখা। কিন্তু বাহ্যিক ও বস্তুভিত্তিক উপায়াদিকেও উপেক্ষা করবে না এবং সাধ্যানুযায়ী বৈধ উপায়াদি অবলম্বন করবে। ইয়াকূব আ. তা-ই করেছিলেন এবং রাসূলুল্লাহ ﷺ এ শিক্ষাই দিয়েছিলেন।

(এগার) আলোচিত ঘটনায় হযরত ইয়াকুব আ. এর অবস্থা থেকে প্রমাণিত হয় যে, জান-মাল ও সন্তান-সন্ততির ব্যাপারে কোন মুসীবত ও দুঃখ কষ্ট দেখা দিলে, প্রত্যেক মুসলমানের কর্তব্য হচ্ছে-সবর ইখতিয়ার করে আল্লাহ তা‘আলার ফয়সালার উপর সন্তুষ্ট থাকা এবং ইয়াকূব আ. ও অন্যান্য পয়গাম্বরের আ. অনুসরণ করা।

(বার) আলোচ্য কাহিনীতে উল্লেখ করা হয়েছে যে, হযরত ইউসুফ আ.- কে যখন তাঁর ভাইয়েরা চিনে ফেলল, তখন তারা অতিরিক্ত কিছু তথ্য জানার জন্য তাকে প্রশ্ন করল- “সত্যি সত্যিই কি তুমি ইউসুফ?” উত্তরে ইউসুফ আ. বললেন “হ্যাঁ, আমিই ইউসুফ আর এ হচ্ছে আমার সহোদর ভাই।” অতঃপর তিনি আরও বললেন- “আল্লাহ তা‘আলা আমাদের প্রতি অনুগ্রহ ও কৃপা করেছেন। নিশ্চয় যারা তাক্বওয়া অবলম্বন করে এবং বিপদাপদে সবর করে, আল্লাহ পাক এহেন সৎকর্মীদের প্রতিদান বিনষ্ট করেন না।” এখানে লক্ষণীয় বিষয় হল যে, হযরত ইউসুফ আ. হাজারো দুঃখ কষ্টের প্রান্তর অতিক্রম করে যখন ভাইদের সাথে পরিচিত হলেন, তখন পূর্ববর্তী কোন বিপদাপদের কথাই তিনি উল্লেখ করলেন না বরং আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে প্রাপ্ত নিয়ামতসমূহের কথাই শুধু স্মরণ করলেন এবং উল্লেখ করলেন।

এ থেকে বুঝা যায় যে, মানুষ যখন কোন বিপদ ও কষ্টে পতিত হয়, এরপর আল্লাহ পাক যখন তাকে বিপদ থেকে মুক্তি দিয়ে নিয়ামত দ্বারা ভূষিত করেন, তখন তার উচিত-অতীত বিপদাপদ ও দুঃখ-কষ্টের কথা উল্লেখ না করে উপস্থিত নিয়ামত ও অনুগ্রহের কথা স্মরণ করা। কেননা, বিপদ থেকে মুক্তি ও খোদায়ী নিয়ামত লাভ করার পরও অতীত দুঃখ-কষ্টের কথা মনে করে হা-হুতাশ করা অকৃতজ্ঞতারই পরিচায়ক। কুরআন মাজীদের সূরাহ ‘আদিয়াত-এ এ ধরনের অকৃতজ্ঞতাকে কানূদ كنود বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কানূদ ঐ ব্যক্তিকে বলা হয় যে নিয়ামত ও অনুগ্রহ স্মরণ না করে শুধু কষ্ট ও বিপদাপদের কথাই স্মরণ করে।

পরিশেষে আমাদের কর্তব্য-পবিত্র কুরআনে বর্ণিত নবী-রাসূলগণের কাহিনী ও ঘটনা আমাদের জীবনের সাথে মিলিয়ে আমাদের জীবনের ভুল-ত্রুটিগুলো শুধরে নেয়া এবং নবীগণের আদর্শ গ্রহণ করে জীবনকে সাফল্যমণ্ডিত করা। আল্লাহ তা‘আলা পবিত্র কুরআনে নবী-রাসূলগণের ঘটনা আমাদের নিকট এজন্যই উল্লেখ করেছেন।

মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমাদের সকলকে আলোচিত ঘটনা থেকে শিক্ষা হাসিল করে সর্বপ্রকার চক্রান্ত ও প্রতারণামূলক কার্যকলাপ থেকে দূরে থেকে নবীওয়ালা আদর্শিক চরিত্রে চরিত্রবান হওয়ার তাওফীক দান করুন। (আমীন)

  • মুফতী মনসূরুল হক 
  • প্রধান মুফতী ও শাইখুল হাদীস


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Be alert before spamming comments.

নবীনতর পূর্বতন

Sponsored

Responsive Ad